উপবাস কি? একাদশী কেন করা হয়?

 


·         উপবাস: সাধারণত উপবাস বলতে আমরা উপোস অর্থা নির্দিষ্ট সময় আহার বর্জন করাকে বুঝি। এছাড়া অনেকে উপবাসকে অনশন বলে। বিষয়ে বঙ্গীয় শব্দকোষ একই কথা বলছে। উপবাস মূলত অনশন বা উপাস থাকাকে বুঝায়। নিচে স্ক্রিনশট যুক্ত করলাম

বঙ্গীয় শব্দকোষ; খণ্ড-; পৃষ্ঠা: ৪২৭

কিন্তু একই গ্রন্থের দাবী বৈদিক শাস্ত্রে এই উপবাসের অর্থ ভিন্ন ছিল। সময়ের সাথে সাথে এটির অর্থ পরিবর্তন হয়ে উপাস হয়েছে। প্রচীন শাস্ত্রে উপবাস শব্দের অর্থ ছিল নিকটে বাস অর্থা উপ=নিকট। যজ্ঞের অগ্নির সামনে নিয়ম পালন পূর্বক অর্থা শুদ্ধ বস্ত্র পরিধাণ করে ঈশ্বরস্তুতি করতে করতে অগ্নির কাছে বাস করাটাই উপবাস। গ্রন্থে স্পষ্ট বৈদিক শাস্ত্রদির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শতপথ ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, শ্রৌতসূত্রে উপবাস শব্দের অর্থ অনশন নয়। অর্থা সম্পূর্ণ ভাবে অনাহার নয়। কারণ, ব্রতোপযোগী আহারের ব্যবস্থা সর্ব্বত্রই আছে। এখানে রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে গোভিলগৃহ্যসূত্রের। এরপর সরাসরি লেখক ধারণা করেছেন, সম্ভবত সময়ের সাথে সাথে উপবাস শব্দটির অর্থ অনশন হয়েছে। নিচে স্ক্রিনশট যুক্ত করা হল


বঙ্গীয় শব্দকোষ; খণ্ড-; পৃষ্ঠা: ৪২৭

এবার আমরা শতপথ ব্রহ্মণে এর সত্যতা খোঁজ করি। শতপথ ব্রাহ্মণের প্রথম কাণ্ড, প্রথম প্রপাঠক, প্রথম ব্রাহ্মণের নাম্বার মন্ত্রে বলা হয়েছে, নিকটে বাস করে বলিয়া এই ব্রতের নাম উপবসথ


শতপথ: ///;

হিন্দুর উপাসনা তত্ত্ব বইয়ে উপবাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, উপবাস দ্বারা সত্ত্ব শক্তির বৃদ্ধি আহারের প্রতি আসক্তির নাশ হয়। অর্থা বৈদিক যুগে উপবাস শব্দ নিকটে আসা বুঝালেও মানুষ অনাহারে থেকে এই ব্রত পালন করতো। এই কারণে ভবিষ্য পুরাণেও একই কথা বলা হয়েছে। সমস্তপ্রকার পাপকাজ থেকে বিরত থেকে এবং ইন্দ্রিয় ভোগ্য বিষয় থেকে বিরত হয়ে সাত্ত্বিক গুণ ধারণ করাই উপবাস। এখানে দেখুন, আগুনের নিকটে বাস করার কোন উল্লেখ নেই। কেবল আহার বাদ দেওয়া এবং সত্ত্বগুণ ধারণ করাকেই উপবাস বলা হচ্ছে।

হিন্দুর উপাসনা তত্ত্ব: পৃষ্ঠা ৭৯

রামায়নেও এই ব্রতোপবাস পালনের নিদের্শ পাওয়া যায়। বাল্মীকি রামায়নের অযোধ্যাকাণ্ডের ২৬তম অধ্যায়ে এর উল্লেখ রয়েছে

বাল্মীকি রামায়ণ: অযোধ্যা কাণ্ড; অধ্যায়: ২৬; শ্লোক: ২৯; (গীতাপ্রেস)

অর্থা বুঝা যাচ্ছে যে বৈদিক যুগে উপবাস অর্থ কেবল আগুনের সামনে বাস করা এক ব্রতোপাসনা বুঝালেও পৌরাণিক যুগে এসে এটির অর্থ পরিবর্তন হয়েছে

·         একাদশী: একাদশী একটি তিথির নাম। মহাভারতেও একাদশী তিথির উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সময়ে আমরা যে একাদশী ব্রত পালন করি সেটি সম্ভবত মহাভারতের একাদশী তিথি। কিন্তু একাদশী মাহাত্ম্য বইয়ে যেসকল নিয়মাবলি পাওয়া যায় এবং শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের প্রত্যেক একাদশী নিয়ে যে আলোচনা পাওয়া যায়, সেগুলো মহাভারতে নেই। এছাড়া বৈদিক শাস্ত্রেও এই ব্রত পালনের কোন প্রমান পাওয়া যায়না। অনেকেই মনে করেন, ক্রিয়াযোগসারে যে হরিবাসরের উল্লেখ রয়েছে, সেটিই আস্তে আস্তে একাদশীতে পরিনত হয়েছে। প্রবাসী বইয়ের সপ্তম ভাগ, দ্বিতীয়াংশতে মুটামুটি ভাবে আলোচনা হয়েছে। আপনারা পড়ে নিতে পারেন


প্রবাসী: সপ্তম ভাগ, দ্বিতীয়াংশ; পৃষ্ঠা: ৫২৮

তাহলে দেখা যাচ্ছে শ্রুতিতে একাদশীর উল্লেখ না থাকলেও পুরাণ সমূহে এবং বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রে এই একাদশী ব্রতের উল্লেখ রয়েছে। বিষ্ণু সংহিতায় একাদশী তিথিতে উপবাস থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে উপবাস অর্থ নিকটে বাস নাকি উপোস সেটি বুঝা যায়না। তবে আমার ধারণা এখানে উপোস বুঝানো হয়েছে। বর্তমানে প্রেক্ষাপটে সবাইকে একাদশীতে উপোস থাকতে দেখা যায়

বিষ্ণু সংহিতা: ৪৯/

একাদশীর নিয়মাবলীতে পাওয়া যায় একাদশী উপবাস নির্জলা পালন করতে হবে এবং সম্পূর্ণ রাত্রি জেগে থাকতে হবে।


শ্রী মাধব তিথি: পৃষ্ঠা: ৩০

একাদশীর পর আমরা যে টি মহাদ্বাদশী পালন করি, সেটির উল্লেখও বৈদিক শাস্ত্রে নেই। মাধব তিথি গ্রন্থ অনুসারে ইহার উল্লেখ পাওয়া যায় হরিভক্তিবিলাসে।


শ্রী মাধব তিথি; পৃষ্ঠা: ২৭

কিন্তু এই সকল নিয়ম (নির্জলা, রত্রি জাগরণ) গীতার বিরুদ্ধ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান বলছেন, অধিক নিরাহার এবং রাত্রিজাগরণ যারা করে তাদের যোগ-সাধন সম্ভব নয়


গীতা: /১৬; সরস্বতী গোস্বামী ভাষ্য

এছাড়া বিজ্ঞান সম্মত ভাবেও অনাহার বা রাত্রি জাগরণ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু অনেক ধর্মাজ্ঞরা একাদশী উপবাসের এই নিয়মকে বিজ্ঞান সম্মত বলেন, যার নাম অটোফেজি। কিন্তু অটোফেজি আর একাদশী প্রসেস এক নয়। চলুন অটোফেজি সম্পর্কে জানা যাক

·         অটুফেজি: চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জাপানের অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি। জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে এবং কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সুস্থ থাকে, সেই রহস্য বের করার কারণে নোবেল পুরস্কার পেলেন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের ভাষায় প্রক্রিয়াকে বলা হয় অটোফেজি। অটোফেজি প্রক্রিয়াটি আসলে কি? অটোফেজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটো ফাজেইন থেকে। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছেআত্ম ভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। বিষয়টি শুনতে ভয়ানক হলেও এটা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কেননা এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে পরিষ্কার করার একটা প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয় কোষীয় পর্যায়ে। শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি হয় এবং প্রোটিনের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রোটিনের গঠনটি অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা ত্রিমাত্রিক হতে হয়। যদি ত্রিমাত্রিক না হয় তবে প্রোটিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হতে নানা রোগের সৃষ্টি করবে। এর জন্য সাধারণভাবে উপবাস অর্থা উপোস থাকতে হয় প্রায় ১৩-১৫ ঘন্টা। তবে এই সময় প্রচুর পরিমানে পানি পান করতে হয়। অন্য সকল খাবার বাদ দিতে হয়। এরপর ১৮ তম ঘণ্টা থেকে অটোফেজি সক্রিয় হয়। কোনো কোনো গবেষণায় অবশ্য দেখা গেছে যে, ১৩ তম ঘণ্টা থেকেও অটোফেজি সক্রিয় হয়েছে। কাজেই আমরা বলতে পারি যে, উপবাসের ১৩তম থেকে ১৮ ঘণ্টায় গিয়ে আমাদের দেহে অটোফেজি প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। সক্রিয় হয় তখন কোষের আবর্জনা ক্ষয়ে যাওয়া কোষ রিসাইক্লিং এবং নতুন কোষাণু তৈরি শক্তি ৎপাদন। কিন্তু এই সময় যদি কেউ সম্পূর্ণ অনাহারে থাকে অর্থা পানি পান না করে তাহলে অটোফেজি করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যাবে। সুতরাং অটোফেজি এবং নির্জলা একাদশী এক নয়।

অটোফেজি প্রক্রিয়া

তাহলে যারা একাদশী পালন করেন, তারা বিজ্ঞান সম্মত ভাবে কিভাবে পালন করবেন? এই প্রশ্নের কিঞ্চি সমাধান আমি লিখে দিচ্ছি। আপনাদের মনপ্লুত হলে এভাবে একাদশী পালন করতে পারেন। আরেকটি কথা, এই ব্রত উপাসনা একান্তই আপনার মনের অভিরুচি। অনেকেই বলে একাদশীতে অন্নতে পাপ বিরাজ করে। এমন মন্তব্য পৌরাণিক শাস্ত্রদিতে থাকলেও বৈদিক শাস্ত্রে নেই। বরং বৈদিক শাস্ত্রে অন্নকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। আর ব্রহ্মে কিভাবে পাপ প্রবেশ করে আমার জানা নেই। তবে ১৫ দিন অন্তর অন্তর একাদশীতে অটোফেজি প্রসেস মেনে চললে ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটোই মানা যায়

এই কাজটির জন্য আমাদের খুব সহজ একটি নিয়ম মান্য করতে হবে।
একাদশীর দিন কোন কিছুই খাওয়া যাবে না, কিন্তু হাফঘন্টা পর পর পেট ভর্তি করে জল পান করতে হবে। আমি আবার বলছি, জল ছাড়া আর কোন কিছুই খাওয়া যাবে না। আর অবশ্যই হাফঘন্টা পর পর পেট ভর্তি করে জল পান করবেন।
এতে দেখা যাচ্ছে, নির্জলা থাকতে হচ্ছে না। যা গীতা এবং বিজ্ঞান সম্মত। এদিকে নির্জলা না থাকলেও কেবল জল পান করার কারণে আপনার একাদশী পালনেও সমস্যা হচ্ছে না। এই ভাবে আপনি একাদশীকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পালন করতে পারেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ