ব্রহ্মা

 

“ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর! তিনে মিলে কি? "একঈশ্বর”

 

“ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর! তিনে মিলে "একঈশ্বর”

অনেকের মুখে এমন একটা কথা শুনা যায়.....

 

যদি বেদের আলোকে বিচার করি, তাহলে এই কথাটি ভুল হবে। বেদের আলোকে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তিনে মিলে একঈশ্বর হবে না বরং হবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এক ঈশ্বরের তিনটি গুণবাচক নাম। বিশেষ করে বর্তমানে প্রচলিত পুরাণের অনুসারি, পৌরাণিক বন্ধুরা মনে করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর তিনটি আলাদা আলাদা সত্তা, কিন্তু বেদের আলোকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কোন সত্তা নয়; বরং এক ঈশ্বরের তিনটি গুণবাচক নাম।

পবিত্র বেদে বলা হয়েছে.....

 

য এক ই তমু ষ্টুহি কৃষ্টীনাং বিচর্যণিঃ পতি র্জজ্ঞে বৃষক্রতুঃ।।

ঋগ্বেদ. ৬/৪৫/১৬।

বঙ্গানুবাদঃ- যিনি এক অদ্বিতীয়, যিনি মনুষ্যদের সর্ব্বদ্রষ্টা,

যিনি সর্ব্বশক্তিমান ও পালক একমাত্র তাঁহাকেই উপাসনা কর।

 

ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয় শ্চতুর্থো নাপ্যুচ্যতে।

ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপ্যুচ্যতে।

নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপ্যুচ্যতে।

য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।

অথর্ব্ববেদ. ১৩/৪/২।

বঙ্গানুবাদঃ- পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ,

পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হয় না।

যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন। এক ঈশ্বর

চিন্তন জ্ঞানীর, বহু ঈশ্বরের ধারণা মুর্খের।

 

ইন্দ্রং মিত্রং বরুণ মগ্নি মাহু,

রথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান।

একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।

ঋগ্বেদ. ১/১৬৪/৪৬।

বঙ্গানুবাদঃ- এক সত্তা পরব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য,

সুপর্ণ, গরুমান, যম, মাতরিশ্বা আদি বহু নামে অভিহিত করেন।

 

অর্থা পরমাত্মা এক এবং অদ্বিতীয় কিন্তু বেদে এক ঈশ্বরের অনেক গুণবাচক নাম উল্লেখ্য করা হয়েছে। বেদে ব্রহ্মা, রুদ্র, শিব, মহাদেব এরুপ অনেক নাম আছে। দুষ্ট কে দন্ড দেন বলে তিনি রুদ্র, মঙ্গলময় এবং সকলের কল্যাণকারী বলে তিনি শিব, সূর্য্যাদি পদার্থ সমূহের প্রকাশক বলে তিনি মহাদেব, এরুপ ভাবে সর্বত্র ব্যাপক বলে ঈশ্বরের আর এক নাম "বিষ্ণু"। অর্থা এরুপ ভাবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এক ঈশ্বরের তিনটি গুণবাচক নাম।

 

এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন তা হচ্ছে.....

তাহলে আমরা যে দেখি শিবের মাথায় জটা আছে, শিবের তিনটি চোখ, একটি চোখ কপালের মাঝখানে থাকে, শিবের হাতে থাকে ডমরু নামক বাদ্যযন্ত্র এবং ত্রিশূল নামক অস্ত্র থাকে। আবার ব্রহ্মার চার মাথা, চার হাত; আবার বিষ্ণু কে দেখি শঙ্ক, চক্র, গদা, পদ্ম ধারি চতুর্ভুজ মূর্তি; সমুদ্র ভাসমান সহস্র নাগ দারা আচ্ছাদিত বিশেষ কোন বিছানায় বিষ্ণু শায়িত আছেন আর তার স্ত্রী লক্ষ্মী পা টিপছে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে তিন জনের আলাদা আলাদা রুপ আছে, তারা পৃথক পৃথক সত্তা; তারা তিন জন যেহেতু ঈশ্বর, তাই তারা তিনে মিলে এক ঈশ্বর হয়েছে।

 

উত্তরে আমি বলব.....

দেখুন! পূর্বেই বলেছি, আমি যা বলেছি তা বেদের আলোকে বলেছি। আপনি যে সকল পৃথক পৃথক রুপের কথা বলছেন এগুলা পুরাণে আছে কিন্তু বেদে নাই। সনাতন ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে “বেদ” আর সেখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এর এইরুপ পৃথক পৃথক কোন রুপের কথা বর্ণনা নাই। তাই এটাও আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে বর্তমান প্রচলিত পুরাণের বর্ণিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আর বেদের এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের গুণবাচক নাম ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নামের সেই পরমাত্মা এক নয়। কারণ যেহেতু বেদ আর পুরাণ সাংঘর্ষিক, পরস্পর বিরোধী।

 

যে কেও আমার সাথে দ্বিমত করতে পারেন বা যদি করেন; অর্থা আমাকে যদি বলেন আপনার ধারণ ভুল, আপনি ভুল বলছেন, বেদের আলোকেও “ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, তিনে মিলে একঈশ্বর’ই হবে। তবে আমি তাকে অনুরোধ করব, দাদা! তাহলে বর্তমান প্রচলিত পুরাণ সমূহে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সম্পর্কে যে বর্ণনা গুলো দেয়া আছে, সেই বর্ণনা গুলা বেদ থেকে আমাকে দেখিয়ে দেন। যেমন বিষ্ণু সম্পর্কে বললে এমন কিছু প্রশ্ন আসে.....

 

বিষ্ণু শঙ্ক, চক্র, গদা, পদ্ম ধারি এটা বেদের কোথায় আছে? কত নং মন্ত্রে আছে?

বেদের বিষ্ণু হচ্ছে সর্বব্যাপক কিন্তু তাকে দারোয়ান রেখে পাহারা দিয়ে থাকতে হয় এটা বেদের কোথায় আছে?

বিষ্ণু মহাসমুদ্রে ভাসমান, অসংখ্য নাগ বিশিষ্ট কোন বিছানায় শুনে আছেন এটা বেদের কোথায় আছে?

বিষ্ণু শুয়ে আছেন তার স্ত্রী তার পা টিপছে এটা বেদের কোথা আছে?

বিষ্ণুর স্ত্রী আছে এটা বেদের কোথায় আছে?

বিষ্ণু রুপ ধারণ করেছেন বা করেন এটা বেদের কোথায় আছে?

কোন এক কথিত ভিৃগু মুনি এসে বিষ্ণুর বুকে লাথি মেরেছে, এটা বেদের কোথায় আছে? ভিৃগু বিষ্ণুকে লাথি তো মারলো এমন লাথি মেরেছে তাতে তার পায়ের চিহ্ন বিষ্ণুর বুকে জন্মেরমত ছাপ পড়ে গেছে এটা বেদের কোথায় আছে???

[এভাবে পুরাণের ভগবান বিষ্ণুকেই লাথি মারা সম্ভব কিন্তু বেদের পরমাত্মা বিষ্ণু কে লাথি মারা কখনো সম্ভব না]

 

এভাবে মহেশ্বর সম্পর্কে এবং ব্রহ্মা সম্পর্কে অনুরুপ প্রশ্ন আসে, অর্থা বর্তমান প্রচলিত পুরাণ সমূহে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সম্পর্কে যে বর্ণনা গুলো দেয়া আছে, সেই একি বর্ণনা গুলা বেদ থেকে দেখিয়ে দেন, উপযুক্ত প্রমাণ সহ।

 

সব শেষে বেদের আলোকে বলব.....

সংগচ্ছধবং সংবদদ্ধং সংবো মানাংসি জানতাম্।

দেবাভাগং যথাপূর্ব্বে সংজানানা উপাসতে।।

ঋগ্বেদ. ১০/১৯১/২|

বঙ্গানুবাদঃ- হে মনুষ্য! তোমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলিয়া আলোচনা কর, তোমাদের মন উত্তম সংস্কার যুক্ত হউক। পূর্ব্বকালীন জ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছেন তোমরাও সেইরূপ কর।।

 

এখন কি? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এর তিনটি পৃথক পৃথক সত্তা, রুপ দিয়ে বিষ্ণুর পূজারীরা বৈষ্ণব, তারা কপালে তিলক দিবে, গলায় তুলসির মালা পড়বে, তুলসি কাঠের তৈরি গুটি গুণবে; আর মহেশ্বর পূজারীরা হবে শৈব, তারাও শৈব তিলক দিবে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরবে, তার রুদ্রাক্ষের গোটা দিয়ে জপ করবে। এভাবে পৃথক পৃথক ব্যবস্থা তৈরি করে, আলাদা আলাদা সম্প্রদায় সৃষ্টি করে; শৈব বলবে শিব শ্রেষ্ঠ, বৈষ্ণব বলবে বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ। একে অপরকে নাস্তিক, পাষাণ্ড বলে গালমন্দ করে পরস্পর ঝগড়া, বিবাদ কলহে লিপ্ত হলে সেটা উত্তম হবে? নাকি বেদ কে আশ্রয় করে সকলে এক সত্তা পরমাত্মার উপাসনা করলে সেটা উত্তম হবে? তা আপনারই বিচার করুন।

 

সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানসংখ্যক মন সহচিত্তমেষাম্।

সমানসংখ্যক মন্ত্রমভি মন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি।।

ঋগ্বেদ.১০/১৯১/৩|

বঙ্গানুবাদঃ- তোমাদের সকলের মত এক হউক, মিলন ভূমি এক হউক, মন এক হউক, সকলের চিত্ত সম্মিলিত হউক, তোমাদের সকলকে একই মন্ত্রে সংযুক্ত করিয়াছি, তোমাদের সকলের জন্য অন্ন ও উপভোগ একই প্রকারে দিয়াছি।।

 

 

 

ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর আসলে কে বা কী ?

 

হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ‘ব্রহ্ম’ও বলা হয়, আবার এনাকে ঈশ্বর নামেও ডাকা হয়। এই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন- ব্রহ্মা রূপে সৃষ্টি, বিষ্ণু রূপে পালন এবং মহাদেব বা শিব রূপে ধ্বংস। কিন্তু অজ্ঞতা ও বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে আমরা এতদিন অনেকেই মনে করেছি বা জেনে এসেছি যে, ব্রহ্মের তিনটি রূপ বা ব্রহ্ম তিনভাগে বিভক্ত, যথা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তাই আমরা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে আলাদা আলাদা তিনটি সত্ত্বা বিবেচনা করেছি এবং তাদের আলাদা মূর্তি প্রথমে কল্পনা ও পরে তৈরি করেছি; শুধু তাই নয়, তাদের প্রত্যকের স্ত্রী সৃষ্টি করেছি, পরে বহু দেবতার জন্ম দিয়েছি, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে সেরকম কিছু নয়।

 

একজন লেখক যখন কল্পনা করে কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখে, তখন লেখক কিন্তু একাই সমস্ত চরিত্র সৃষ্টি করে। এর মানে হলো নায়কও লেখক, নায়িকাও লেখক, নায়ক-নায়িকার পিতা-মাতাও লেখক আবার ভিলেন এবং সকল পার্শ্ব চরিত্রও লেখক। অর্থাৎ লেখক একাই ঐ গল্প বা উপন্যাসে সবাইকে সৃষ্টি করে এবং যাকে যেভাবে ইচ্ছা চালিত করে এবং যার মুখ দিয়ে যা খুশি সংলাপ বের করে। ঠিক একইভাবে এই মহাবিশ্ব, তার মধ্যে পৃথিবী এবং তার উপর মানুষসহ সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করে পরমব্রহ্ম সেই একই কাজ করে চলেছে, এখানে আর কারো কোনো ভূমিকা নেই, সকল ভূমিকা কেবল ঈশ্বররূপী পরমেশ্বর বা পরমব্রহ্মের, কারণ তিনিই সকল কিছুর পরিচালক।

 

উপরেই উল্লেখ করেছি- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা- আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়; ব্রহ্ম যখন সৃষ্টির কাজ করেন তখন তিনি ব্রহ্মা, যখন তিনি পালনের কাজ করেন তখন তিনি বিষ্ণু, আর যখন তিনি ধ্বংসের কাজ করেন, তখন তিনিই মহেশ্বর। একটি উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও সহজ হবে; ধরে নিন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি মন্ত্রণালয় আছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি ঐ মন্ত্রণালয়গুলোও দেখাশোনা করেন। এই অবস্থায় তিনি যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে ফাইলে সই করেন বা করবেন, তখন কিন্তু তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং ব্রহ্মের ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। এজন্যই বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার কৃষ্ণ, পালনের পাশাপাশি যুদ্ধ ও হত্যার মাধ্যমে পাপী ও দু্ষ্টদের বিনাশ করেছেন।  ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে যদি আলাদা আলাদা সত্ত্বা্ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের কাজ ছিলো শুধু পালন করা, তার তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাঁধানোর কোন প্রয়োজন ছিলো না; প্রয়োজন ছিলো না শিশুকালেই রাক্ষসী ও অসুরদের, পরে কংস ও শিশুপালকে হত্যা করার এবং ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ ও দুর্যোধনকে হত্যা করানোর ?

 

আসলে কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু, আর বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম, একইভাবে ব্রহ্মা এবং শিব মানেই পরমব্রহ্ম বা পরমেশ্বর।

 

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আলাদা আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, তারা একই ব্রহ্মের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র। তাই ব্রহ্মা মানেও যেমন পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, তেমনি বিষ্ণু বা শিব মানেও পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, তাই শিব যেমন পরমাত্মা, তেমনি বিষ্ণু এবং ব্রহ্মাও পরমাত্মা এবং এই পরমাত্মা তিনটি নয়, একটি ই; কারণ একই পরমাত্মা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকর রূপের নাম হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। বাস্তবে এরা তিন নয়, এক এবং সেই এক হলো পরমব্রহ্ম বা পরমেশ্বর, তাই পরমাত্মাও একটি ই।

 

 ব্রহ্মা হলো বিজ্ঞান, বিষ্ণু হলো কাণ্ডজ্ঞান, শিব হলো পরাজ্ঞান

সুপ্রভাত

সু

শ, ষ, স।

বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে- ‘স’ অর্থ বিষ্ণু। ‘শ’- শিব। ‘ষ’- ব্রহ্মা।

সু হলো ‘স’ এর উদ্বোধন- অর্থা অস্তিত্বে যে বিষ্ণু সত্তা সুপ্ত আছে তার উন্মেষ।

জ্ঞানের দিক থেকে বিবেচনা করলে:

‘স’ বা বিষ্ণু হলো কাণ্ডজ্ঞান;

‘ষ’ বা ব্রহ্মা হলো বিজ্ঞান;

‘শ’ বা শিব হলো পরাজ্ঞান।

বৃক্ষ মাটি থেকে যে রস সংগ্রহ করে কাণ্ড তা  সকল শাখা-প্রশাখা ও পত্র-পুষ্পে সমানভাবে প্রেরণ করে। কাণ্ডের এই জ্ঞানকে বলা হয় কাণ্ডজ্ঞান। দৈনন্দিন জীবনযাপনে বিজ্ঞান, পরাজ্ঞান ছাড়াও চলে, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না।

কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞান হয় না।

বিজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে পরাজ্ঞান হয় না।

 

প্র

প্র একটি উপসর্গ।

‘প্র’ উপসর্গটির অর্থদ্যোতকতা তো আছেই, এর নিজস্ব অর্থবাচকতাও আছে।

‘প্র’ এর নিজস্ব অর্থ গতি, আরম্ভ, প্রকর্ষ, অত্যন্ত, প্রাথমা, খ্যাতি, উপত্তি, শক্তি, শুদ্ধি, পূজা, উন্নতি, ইচ্ছা, তৃপ্তি, প্রজ্ঞাত, পুরুষ-প্রকৃতি ইত্যাদি।

‘প’ এর সঙ্গে র-ফলা যুক্ত হয়ে প্র হয়েছে। র-এর আবর্তন হলো র-ফলা। প অর্থ রক্ষণ, র অর্থও রক্ষণ। তার মানে, সৃষ্টিধারা রক্ষায় একজোড় পুরুষ-প্রকৃতি হলো প্র।

প্র অদ্বৈত। কিন্তু এই অদ্বৈতের মধ্যেই রয়েছে পুরুষ-প্রকৃতির দ্বৈত ভাব। অন্যদিকে, অদ্বৈত রূপটিই যে শ্রেষ্ঠ রূপ, এর ইঙ্গিত রয়েছে প্র শব্দের প্রতিটি অর্থে।

প্র যার সঙ্গেই যুক্ত হয়, তাকেই দেয় শ্রেষ্ঠত্বের রূপ। যেমন, প্রখ্যাত, প্রগাঢ়, প্রজাতি, প্রদান, প্রধান, প্রবাহ, প্রমাণ, প্রশান্তি, প্রজ্ঞা। প্র এটিও জানান দেয় যে, পুরুষ ও প্রকৃতির ভেতরে সর্বদা সক্রিয় রয়েছে নিজেকে ক্রমোন্নত করার প্রবণতা।

 

ভা

সুপ্রভাত শব্দের মূলে রয়েছে ‘ভ’। এখানে সু প্র আ ত বর্ণগুলো ব্যবহৃত হয়েছে শুধু ভ-কে সুস্পষ্ট করার জন্য।

ভ বর্ণের অর্থ দীপ্ত হওয়া। অতীতে শুক্রগ্রহকে বলা হতো ভ। নক্ষত্রগণকে বলা হতো ভ-গণ, রাশিচক্রকে বলা হতো ভ-চক্র।

ভ কে বহন করে যে, তাকে বলা হয় ভব। অস্তিত্বশীল প্রত্যেক সত্তাই ভব। কারণ, প্রত্যেকেই ভ বহন করে। যদি কোনো সত্তা ভ বহন না করতো, তবে তা প্রত্যক্ষণ করা যেতো না- উপলব্ধি করা যেতো না তার উপস্থিতি।

অস্তিত্ব নিজেকে প্রকাশ করে আলোর সাহায্যে, তাই আলোকে বলা হয় প্রভা। আলোর অনুপস্থিতি হলো নিভা।

ভাত হওয়া মানে প্রকাশিত হওয়া। ছিল অন্ধকার কিছুই প্রতিভাত হচ্ছিল না। এখন সূর্যের আভায় ভাত হচ্ছে প্রকৃষ্ট রূপে, তাই ভ হলো ভা; ভা হলো ভাত; ভাত হলো প্রভাত; প্রভাত হলো সুপ্রভাত।

 

ত ষোড়়শ ব্যঞ্জনবর্ণ। উচ্চারণ স্থান দন্ত । ত বর্ণের শব্দটি ‘তো’ লিখিত হয়। যেমন, তাই তো। বলদান, অবধারণ, কিন্তু, প্রতিজ্ঞাসূচক, নিশ্চয়ার্থক প্রভৃতি অর্থে ত শব্দের ব্যবহার সর্বাধিক।

ত-এর মধ্যে রয়েছে তারণ। প্রভাতে রয়েছে প্রভার তারিত রূপ। রাতের অন্ধকার কেটে গেলে আলোর যে তারণ শুরু হয়, তা বাহ্য প্রভাত। জীবনের অন্ধকার কেটে গেলে বিষ্ণু প্রভার যে তারণ শুরু হয়, তা সুপ্রভাত।

ত বর্ণযোগে গঠিত শব্দগুলো তারল্য, মৃদুতা ও কোমলতা-ব্যঞ্জক। যে সব ভাষায় ত নেই-  সে সব ভাষায় ত’র কাজটি করে ট। ‘ত’ এবং ‘ট’ উচ্চারণের পার্থক্য থেকেই  ত’র কোমলতা বুঝা যায় । প্রভার সঙ্গে ত যুক্ত হয়ে বুঝিয়ে দিলো যে, প্রভাতে প্রভার তারণ কোমল। এতে আলো আছে- তাপ নেই, ঠিক জ্ঞানের আলোর মতো

  

সৃষ্টির আদিতে প্রথম জীব সয়ম্ভু ব্রহ্মা

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান বলছে সৃষ্টির আদিতে প্রথম জীব সয়ম্ভু ব্রহ্মা যে তিনটি শ্লোক শ্রীকৃষ্ণের কাছে শ্রবন করেছিলেন এবং শ্রীবিষ্ণুর ২০ তম অবতার সেই তিনটি শ্লোক থেকে বেদ ও অষ্টাদশ পুরান সৃষ্টি করেছিলেন, তার প্রমান দিচ্ছে যো ব্রক্ষ্মাণং বিদধাতি পূর্ব্বং যো বৈ

বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণঃ. (- 1/২4 গোপালতাপনী উপনিষদ)

"যিনি সৃষ্টির আদিতে ব্রক্ষ্মাকে বৈদিক জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন এবং পূর্বে বৈদিক জ্ঞান বিস্তার করেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীমদ্ভাগত প্রমান দিচ্ছে অষ্টাদশ পুরাণ ব্যাসের  রচিত...  সেই শ্রীমদ্ভাগবতে (১২ / ৭ / ২৩-২৪)ব্যাসদেব রচিত অষ্টাদশ পুরাণের উলেখ করা হয়েছে-

   "ব্রাহ্মং পাদ্মং বৈষ্ণবঞ্চ শৈবং লৈঙ্গং সগারুড়ম্ ..

    নারদীয়ং ভাগবতমাগ্নেয়ং স্কান্দ সংজ্ঞিতম্ ..

    ভবিষ্যং ব্রহ্মবৈবর্তং মার্কন্ডেয়ং সবামনম্.

   বারাহং মাস্যং কৌর্মঞ্চ ব্রহ্মান্ডাখ্যমিতি ত্রিষট ".

 

প্রজাপতি দেবাদিদেব ব্রহ্মা তাঁর মহান ব্রহ্মসংহিতায় বর্ননা করেছেন-

 

ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দ-বিগ্রহঃ।

অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।।

 

শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ঈশ্বর কেননা তার উপরেও কেউ নেই আর তার সমকক্ষও কেউ নেই। সকল সৃষ্টির পূর্বেও তিনি ছিলেন অার সকল বিনাশের পরেও তিনি থাকবেন। তিনি হচ্ছেন পরমপুরুষ, পরমব্রহ্ম, পরমাত্মা, পরমেশ্বর, সর্বশক্তিমান এক ও অদ্বিতীয় সৎ, চিৎ ও অানন্দময়ী ভগবান। তিনি হচ্ছেন আদি পুরুষ গোবিন্দ এবং সর্বকারনের পরম কারণ।

 

ব্রহ্মা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তাঁর উপাসনা না করে আমরা শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করি কেন?

আমাদের দৈহিক সমস্ত উপাদান এবং জীবনীশক্তি শ্রীকৃষ্ণ থেকে এসেছে। ব্রহ্মা কেবলমাত্র দৈহিক গঠন বা আকৃতি দান করেছেন মাত্র। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ভগবানের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মা ভগবানের দেওয়া উপাদনগুলি নিয়ে নানাবিধ জীব প্রজাতি সৃষ্টি করেছেন।

শ্রীব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণের স্তব করে গীত করেন---

ব্রহ্মা য এষ জগদণ্ডবিধানকর্তা।

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥

"আমি ব্রহ্মা যাঁর শক্তি পেয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা হয়েছি, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দ শ্রীকৃষ্ণকে আমি ভজনা করি॥" (শ্রীব্রহ্মসংহিতা ৫/৪৯)

শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীব্রহ্মার উক্তি থেকে সুন্দর শিক্ষা পাওয়া যায়--- "হে শ্রীকৃষ্ণ, যতদিন পর্যন্ত আপনার প্রতি জগতের মানুষ অনুরাগী না হয়, ততদিন পর্যন্ত তারা জড়জাগতিক মোহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই থাকবে।" (ভাঃ ১০/১৪/৩৬)

শ্রীব্রহ্মা তাঁর দিব্য ভবনা থেকে সঞ্জাত পুত্র শ্রীনারদকে নির্দেশ দিচ্ছেন---

সংসারেহস্মিন্ মহাঘোরে জন্মমৃত্যু সমাকূলে।

পূজনং বাসুদেবস্য তারকং বাদিভিঃ স্থিতম্॥

"জন্ম-মৃত্যু এবং বিভিন্ন রকমের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমন্বিত ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদ-সঙ্কুল জড় সংসার থেকে মুক্ত হতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থাকা। এ সত্য সর্বতত্ত্ববিদ্ স্বীকৃত।"

(স্কন্দ পুরাণ)

অতএব স্বয়ং ব্রহ্মার নির্দেশ অনুসারে এই মানব-জাতির একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরধনা করতে হবে। শ্রীব্রহ্মাকে কৃষ্ণভক্ত জেনে আমাদের তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।

 

গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর।

গুরুরেব পরম ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবেই নমঃ ।।

 

এই গুরু প্রণাম মন্ত্রটি সবাই শুনে থাকবেন। মন্ত্রটির মানে হয় গুরু ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহাদেবের তুল্য, তাই গুরুকে প্রণাম। এর অন্তর্নিহিত অর্থটি হয় গুরু ব্রহ্মা রূপে আমাদের মনে জ্ঞানালোকের বর্তিকা প্রজ্বলন করেন, বিষ্ণু হয়ে সেটিকে বর্দ্ধিত করেন আবার মহেশ্বরের রূপে তিনি আমাদের মনের সমস্ত অজ্ঞানতাকে ধ্বংস করেন। গুরুই আমাদের জীবনে আলোকের দিশারী। এই মন্ত্রের নিত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, এটি নিত্যসত্য। গুরুর সম্বন্ধে এতোটা বলার কারণ আমার একজন বন্ধু আমাকে অনুরোধ করেছেন একলব্যকে নিয়ে কিছু লিখবার জন্য। তাকে ধন্যবাদ তো দিতেই হয় কারণ আজকাল মহাভারত কথা শোনাটায় দেখা যায় একটু ভাঁটার টান। সেটি হয়তো আমার লেখনীর অপারগতার জন্য যাই হোক, গুরুভক্তির জন্য মহাভারতে অমর হয়ে থাকা একটি চরিত্র হচ্ছে “একলব্য”। একলব্য ছিল মগধের অধিবাসী নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র। এই নিষাদরা ছিল অনার্য জাতি বা উপ-জাতি। নিজের প্রতি একলব্যের ছিল গভীর আস্থা এবং সেই সাথে ছিল বিখ্যাত ধনুর্ধর হবার প্রবল বাসনা। সেজন্যই তিনি কুরু কুলের গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েও নিজের উপরে আস্তা হারান নি এবং বনের মধ্য দ্রোণাচার্যের মাটীর মূর্তি গঠন করে দ্রোণাচার্যকে গুরু বলে বরণ করেন ও পরম শ্রদ্ধার সাথে ধনুর্বেদ শিক্ষা অর্জন করতে থাকে তার একক প্রচেষ্টায়।

 

এরপরের ঘটনাটি খুবই দুঃখদ, একলব্যের অস্ত্র সাধনার সময়ে কুরু কুলের বালকদের নিয়ে দ্রোণাচার্য মৃগয়ায় এসেছিলেন এবং তাঁদের একটি কুকুর একলব্যের সাধনার বিগ্ন ঘটালে তিনি এমন একটি বানে সেই কুকুরটিকে বিদ্ধ করেন যাতে করে কুকুরটির রক্তপাত হয় না বটে কিন্তু সে আর তার আওয়াজ করতে পারে না। এ রকম আশ্চর্য ব্যাপার দেখে অর্জুন ঈর্ষান্বিত হন এবং তার ফল স্বরূপ গুরু দ্রোণাচার্যের আদেশে একলব্য তার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিয়ে গুরু দক্ষিণা প্রদান করেন। একলব্যের এই গুরু দক্ষিণা প্রদানের থেকে অনেক কথার সৃষ্টি হয়, যেমন গুরু দ্রোণাচার্যকে আর সে সময়ে একজন শিক্ষকের মহিমায় দেখা যায় না, তাকে নিচু স্তরের একজন মানুষ বলেই প্রতিভাত হয়। তবে এও সত্যি যে মানুষের মনের এই নীচতা আর তার সাথে সাথে তার মহত্ব দুটোই এক সাথে চলতে থাকে - চলতে থাকে বলেই আমরা মানুষ, আমরা যন্ত্র হয়ে যাই না। যাই হোক একলব্যের এই আত্মত্যাগের কারণটি হচ্ছে গুরু দ্রোণর “অর্জুনকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে তৈরি করতেই তিনি এই পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করেছিলেন”। তবে গুরু দ্রোণ মনে হয় ব্যাপারটাকে আরো বৃহত্ত্বর প্রেক্ষাপটেই চিন্তা করেছিলেন আর তাতে ভীষ্ম-বিদুরেরও সায় ছিলো কারণ তারাও গুরু দ্রোণকে একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেবার জন্য কিছুই বলেন নি।

 

তাহলে সেই বৃহত্ত্বর প্রেক্ষাপটটি কি সেটাও দেখা যাক, গুরু দ্রোণ একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেবার প্রাথমিক কারণটা যদিও অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা তথাপি এও সত্য যে একলব্য ছিল মগধদেশের এক উপজাতিদের প্রধানের পুত্র। আবার সে সময়ে মগধ দেশের রাজা ছিল জরাসন্ধ এবং তাঁর সেনাপতি ছিল শিশুপাল। মগধ ছিল হস্তিনাপুরের শত্রু রাজ্য তাই হস্তিনাপুরের অন্নে প্রতিপালিত দ্রোণাচার্য চাননি যে তাঁর কোনো শিষ্য হস্তিনাপুরের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করুক আর তাই চেয়েছিলেন ভবিষ্যতে একলব্য যাতে অজেয় হতে না পারে। এই সব কারণেই গুরু দ্রোণ একলব্যের কাছ থেকে তাঁর ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরু দক্ষিণা হিসেবে গ্রহণ করেন। অতএব, বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একলব্যের প্রতি অন্যায়টা বেশি করে যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে যদিও আমরা একজন গুরুর কাছে এমন নিকৃষ্টতা আশা করি না। অন্যদিকে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা গুরু দ্রোণাচার্যের দূরদর্শিতা ও হস্তিনাপুরের প্রতি আনুগত্যতার পরিচয় পাই। এই কারণেই নীতি শাস্ত্র বিশারদ ভীষ্মও হয়তো মৌনতা অবলম্বন করে গুরু দ্রোণকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন। ফিবিঃ আট দুই সতেরো

 

ব্রহ্মা কি, বিষ্ণু কি, মহা‌দেব কি

শুক‌দেব ব‌লি‌লেন-----ন‌রেন্দ্র ! ব্রহ্মাই কি, বিষ্ণুই কি, মহা‌দেবই কি , সকল দেবতাই শাপ প্রসাদ বা নিগ্রহ-অনুগ্র‌হের অধীশ্বর ; তন্ম‌ধ্যে ব্রহ্মা ও শঙ্কর সর্ব্বদাই‌ শাপ বা প্রসাদ বিতর‌ণে উন্মুখ , কিন্তু বিষ্ণুর ব্যবহার বিপরীত । পুরাতত্ত্বজ্ঞ ব্য‌ক্তিবর্গ এ বিষ‌য়ে একটা ইতিহাস ব‌লিয়া থা‌কেন । পুরাকা‌লে গি‌রিজাপ‌তি বৃকাসুর‌কে বরদান ক‌রিয়া‌ছি‌লেন ; এই বরদা‌নের ফ‌লে তি‌নি যে সঙ্কট-অবস্থায় প‌ড়িয়া‌ছি‌লেন , সেই ইতিহাস বর্ণনা ক‌রি‌তে‌ছি , শ্রবণ কর ।

দুর্ম্ম‌তি বৃকাসুর শকু‌নির পুত্র; সে এক‌দিন প‌থিম‌ধ্যে দেব‌র্ষি নারদ‌কে দে‌খিয়া জিজ্ঞা‌সিল ,----ব্রহ্মা , বিষ্ণু ও শিব, এই দেবত্র‌য়ের ম‌ধ্যে কোন দেব অাশু‌তোষ ?

নারদ উত্তর করি‌লেন,-------‌ দেব গি‌রি‌শের অারাধনা কর, সি‌দ্ধিলাভ ক‌রি‌তে পা‌রি‌বে ; তাঁহার স‌ন্তোষ বা ক্রোধ অল্পমাত্র গুণ-দো‌ষেই হয় । শঙ্কর দশানন ও বাণাসু‌রের প্র‌তি সন্তুষ্ট হইয়া‌ছি‌লেন, তাহা‌দিগ‌কে অতুল ঐশ্বর্য্য দিয়া‌ছি‌লেন ; কিন্তু এই স‌ন্তোস বা প্রসন্নতার ফ‌লে তাঁহা‌কেই অব‌শে‌ষে সঙ্ক‌টে প‌তিত হই‌তে হইয়াছিল । দেব‌র্ষির মু‌খে এই তথ্য শু‌নিয়া বৃকাসুর কেদারতী‌র্থে গমন ক‌রিল এবং তথায় প্রজ্বলিত অন‌লে স্বীয় গাত্রমাংস অাহু‌তি প্রদান ক‌রিয়া শঙ্ক‌রের অারাধনা ক‌রি‌তে লা‌গিল ।

সপ্তাহ-কাল দৈত্য এইরূপ অারাধনা ক‌রিল , তথা‌পি মহা‌দেব-দর্শন মি‌লিল না ; তখন নির্ব্বেদ বশতঃ  বৃকাসুর কেদার-তীর্থজল‌সিক্ত স্বীয় মস্তক  কুঠার-দ্বারা ছেদন ক‌রি‌তে উদ্যত হইল । পরমকারু‌ণিক ধূর্জ্জ‌টি , তক্ষণা হোমানল হই‌তে অন‌লের ন্যায় উণ্থিত হইয়া উভয় হ‌স্তে তদীয় উভয় হস্ত ধ‌রিয়া তাহা‌কে নিবারন ক‌রি‌লেন । শঙ্কর কর স্প‌র্শে বৃকাসুর অান‌ন্দোফুল্ল হইল । শঙ্কর ক‌হি‌লেন,-----অসুর ! নিবৃত্ত হও , নিবৃত্ত হও ; তোমার অ‌ভিল‌ষিত বর অা‌মি প্রদান ক‌রি‌তে‌ছি !  শরণাপন্নগ‌ণের প্র‌তি নিয়তই অা‌মি দয়াবান্ । অ‌হো  ! বৃথা অাত্ম‌ক্লে‌শে তু‌মি উদ্যত । ইহা শু‌নিয়া সেই প‌া‌পিষ্ঠ অসুর শঙ্ক‌রের নিকট সর্ব্বভূত-ভয়াবহ বর প্রার্থনা ক‌রিল । তাহার প্রার্থনীয় বর হইল-------অা‌মি যাহার মস্তক স্পর্শ ক‌রিব , সেই যেন মৃত্যুমু‌খে প‌তিত হয় ।

‌হে কুরুবর ! মহা‌দেব এই কথা শু‌রিয়া ক্ষণকাল দুর্ম্মনা হইয়া র‌হি‌লেন ; প‌রে 'তথাস্তু' ব‌লিয়া ঐ বরই তাহা‌কে প্রদান ক‌রি‌লেন । এই বরদান -

ব্যাপার সর্প‌কে অমৃতদা‌নের ন্যায় হইয়া গেল । বর প্রাপ্ত অসুর তখন পরীক্ষার নি‌মিত্ত বরদাতা শঙ্ক‌রের মস্ত‌কেই করস্পর্শ ক‌রি‌তে উদ্যত হইল । শঙ্কর অাত্মকৃত কর্ম্ম হেতুই ভীত হই‌লেন । তি‌নি ভীত-ত্রস্ত হইয়া ক‌ম্পিতকা‌য়ে উত্তর দিক্ ধ‌রিয়া ধা‌বিত হই‌তে লা‌গি‌লেন , ক্র‌মে ভূতল ও স্ব‌র্গের অন্তসীমায় গমন ক‌রি‌লেন । অসুর ও তাঁহার পশ্চা পশ্চা গমন ক‌রিল । অন্য সু‌রেশ্বরগণ প্র‌তি‌বিধান কিছুই না দে‌খিয়া নিস্তব্ধ র‌হি‌লেন । যথায় সর্ব্বত্যাগী শান্ত----সাধুগ‌ণের পরমগ‌তি সাক্ষা নারায়ণ বিরাজমান এবং যেখা‌নে যাই‌তে পা‌রি‌লে জী‌বের অার পুনরাবৃ‌ত্তি ঘ‌টে না , দেবদেব অাশু‌তোষ অব‌শে‌ষে সেই বৈকুণ্ঠধা‌মে উপ‌স্থিত হই‌লেন । দুঃখহারী হ‌রি শঙ্কর‌কে তথা‌বিদ ত্রস্ত-ব্যস্ত দে‌খিয়া তক্ষণা যোগমায়াব‌লে বটুক‌বেশ ধারণ ক‌রি‌লেন এবং মেঘলা , অ‌জিন, কুশ, দণ্ড ও অক্ষ লইয়া তেজঃ -‌প্রোজ্জ্বল‌দে‌হে অসুর-সমী‌পে অা‌সি‌লেন । অসুর তাঁহা‌কে স‌বিন‌য়ে অ‌ভিবাদন ক‌রিল । ভগবান্ ব‌লি‌লেন,------‌হে শকু‌নি-নন্দন ! তু‌মি দূরপথ-পর্য্যট‌নে প‌রিশ্রান্ত ব‌লিয়াই ল‌ক্ষিত হই‌তে‌ছে ; এক্ষ‌ণে কিয়ক্ষণ বিশ্রাম কর । অাত্মাই পুরু‌ষের সর্ব্বাভীষ্ট--পূরক ; অতএব তাহা‌কে ক্লিষ্ট ক‌রিও না ! হে পুরুষবর ! কি কার্য্য তোমার অভীষ্ট ? য‌দি অামা‌দিগ‌কে শুনাই‌তে কোন বাধা না থা‌কে , ত‌বে প্রকাশ ক‌রিয়া বল ; অা‌মি তাহা পূর্ণ ক‌রিব ।

শুক‌দেব ব‌লি‌লেন,-------ভগবা‌নের অমৃতব‌র্ষিণী কথায় এইরূপ জিজ্ঞা‌সিত হইয়া অপনীত শ্রম অসুর তাহার অতীত ও বর্ত্তমান কার্য্য ভগবা‌নের নিকট নি‌বেদন ক‌রিল । ভগবান্ ত-শ্রব‌ণে ব‌লি‌লেন,------এ অসম্ভব বর ; শঙ্কর সত্যই য‌দি এরূপ বর দিয়া থা‌কেন , ত‌বে তাঁহার কথায় অামার অার বিশ্বাস ক‌রিব না । শঙ্কর দক্ষশা‌পে পৈশা‌চিকবৃত্তি অবলম্ব‌নে পিশাচদি‌গেরই রাজা হইয়াছেন । তাঁহা‌কে জগদ-গুরু-জ্ঞা‌নে য‌দি তাঁহার কথায় তোমার অস্তা থা‌কে , ত‌বে নিজ মস্ত‌কে হস্তার্পণ ক‌রিয়াও ত' পরীক্ষা ক‌রি‌তে পার । যদি শঙ্করদত্ত বর মিথ্যা হইয়া যায়, ত‌বে পরীক্ষা‌ন্তে সেই অসত্যবাদী শঙ্করকে তোমার পরাস্ত করাও ত' অসম্ভব হই‌বে না । তোমার হ‌স্তে পরাস্ত হইলে এরূপ অনৃতবাক্য তি‌নি অার ব‌লি‌বেনও না । ভগবদুক্ত ঈদৃশ কোমল ও বি‌চিত্র বা‌ক্যে অসুর হতবু‌দ্ধি হইল ; সে বি‌স্মিতভা‌বে নিজমস্ত‌কেই হস্ত স্থাপন ক‌রিল । তক্ষণমাত্রই‌ অসু‌রের মস্তক ছিন্ন হইল , সে বজ্রাহ‌তের ন্যায় ভূপৃ‌ষ্ঠে প‌তিত হইল । এই ব্যাপা‌রে স্ব‌র্গে 'জয় জয়' ধ্ব‌নি , 'সাধু সাধু ' বাণী ও 'ন‌মো নমঃ ' শব্দ উণ্থিত হইল ; পাপ বৃকাসু‌রের পত‌নে প্রহৃষ্ট হইয়া  দেব , ঋষি, পিতৃ ও গন্ধর্ব্বগণ পুষ্পবর্ষণ করি‌তে লা‌গি‌লেন । শঙ্করও সঙ্কট-মুক্ত হই‌লেন । তখন পুরু‌ষোত্তম বিষ্ণু  শঙ্কর সমী‌পে অা‌সিয়া ক‌হি‌লেন ,----অ‌হো ! পাপ বৃকাসুর নিজ পা‌পেই নষ্ট হইয়া‌ছে ! হে ঈশ্বর ! মহদব্য‌ক্তি দি‌গের প্র‌তি অপরাধ ক‌রিয়া কোন্  ব্য‌ক্তি শ্রে‌য়োলাভ ক‌রি‌তে পা‌রে ? অাপ‌নি চরাচরগুরু ; অাপনার নিকট যে দুর্ব্বৃত্ত অপরাধী হয় , তাহার কথা অার বলাই বাহুল্য ।

‌হে নৃপ ! শ্রীহ‌রি অবাঙ্মনস‌গোচর অসীম শ‌ক্তিধর সাক্ষা পরমাত্মা পর‌মেশ্বর । তকৃত এই শিব‌মোচন ব‌ার্ত্তা যি‌নি শ্রবণ বা কীর্ত্তন ক‌রেন , তি‌নি শত্রুহস্ত হই‌তে ----- এমন কি , এই ভব-বন্ধন হই‌তেই মুক্ত হইয়া পরমগ‌তি প্রাপ্ত হইয়া থা‌কেন ।

 

 

ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের মধ‍্যে কে শ্রেষ্ঠ ?

 

একবার ঋষিদের মনে প্রশ্ন উঠলো যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের মধ‍্যে কে শ্রেষ্ঠ ? তখন দেবর্ষি নারদ পরামর্শ দিলেন তাদের মধ‍্যে কেউ একজন গিয়ে ত্রিদেবের পরীক্ষা নিয়ে দেখতে ,  যে দেবতা ত্রিগুনাতীত হবেন তিনিই শ্রেষ্ঠ এই কথায় ভৃগু ঋষি গেলেন তাদের পরীক্ষা নিতে।

 

প্রথমে তিনি ব্রহ্মলোক গেলেন এবং সেখানে ব্রহ্মাকে কটু ভাষায় তিরস্কার করলেন। ব্রহ্মা এতে ক্রুদ্ধ হলে ভৃগু ঋষি তার স্তব করে তাকে শান্ত করেন এবং তার আসার কারন জানান। ব্রহ্মা বললেন " আমি এই অনন্ত ব্রহ্মান্ডের রচয়িতা এবং তা নিয়ে আমি গর্বিত। তাই আমি রজ গুনের অধীন। সেই কারনে আমি শ্রেষ্ঠ নই।"

 

এরপর তিনি কৈলাসে গেলেন। তখন শিব ও পার্বতী একান্তে ছিলেন এবং নন্দি ও অন‍্যান‍্য গনেদের আদেশ দিয়েছিলেন যে কাউকে যেনো ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। কিন্তু ভৃগু ঋষি কোনো বাধা না মেনে কৈলাসে প্রবেশ  করলেন। এতে শিব অত‍্যান্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভৃগু ঋষিকে ভষ্ম করতে উদ‍্যত হলেন, কিন্তু দেবী পার্বতীর অনুরোধে থেমে গেলেন। এরপর ভৃগু ঋষি শিবকে স্তবে তুষ্ট করে নিজের আসার কারন জানালেন। শিব বললেন "ধ্বংসের দেবতা হওয়ার কারনে আমি তমোগুনের অধীন। এই কারনে আমিও শ্রেষ্ঠ নই।

 

এরপর ভৃগু ঋষি বৈকুন্ঠ ধামে প্রস্থান করলেন। সেখানে তিনি দেখলেন ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় মগ্ন। এই দেখে তিনি শ্রীহরির বুকে পদাঘাত করলেন। এতে ভগবান বিষ্ণু জেগে তার চরন ধরে বললেন "এ আপনি কি করলেন ঋষিবর! আমার ছাতি বজ্রের মতো কঠোর, আপনার কোমল চরনে যদি কোনো ব‍্যাথা পেয়ে থাকেন তাহলে আমি অত‍্যন্ত দুঃখিত। আমি নিদ্রায় থেকে আপনার সেবা করতে পারিনি এর জন‍্যও আমায় ক্ষমা করুন।" এতে ঋষি ভৃগু লজ্জিত হলেন এবং ভগবান বিষ্ণুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ফিরে গেলেন। তিনি ঋষিদেরকে গিয়ে বললেন ভগবান শ্রীহরি একমাত্র ত্রিগুনাতী তা তিনিই  সর্বশ্রেষ্ঠ ।

 

 

শিবের গাঁজা খাওয়া : প্রকৃত ব্যাপারটা কী ?

অনেকই শিবকে নিয়ে এই ভাবে কটুক্তি করে যে, শিব গাঁজা খায়, আর গাঁজাখোর শিবকে হিন্দুরা পূজা করে, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

যারা এই ভাবে কটূক্তি করে, তারা জানে না শিবের আসল পরিচয়  । এই  বিষয় সবার কাছে পরিষ্কার হবে, আজকের এই পোস্টে।

 

প্রথমেই বলি শিব কে ?

 

যখন আমরা "শিব" বলি, আমরা দুটি মৌলিক দিককে উল্লেখ করছি। "শিব" শব্দটির মানে আক্ষরিক অর্থে হলো "যা নয় সেটা।" আজ, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কাছে প্রমাণ করছে যে সবকিছু  শূন্য থেকে আসে এবং শূন্যে  ফিরে যায়। অস্তিত্বের ভিত্তি  এবং মহাজগতের  মৌলিক গুণ হলো বিশাল শূন্যতা। ছায়াপথগুলো হলো একটা ছোট ঘটনা - ছিটেমাত্র । বাকি সমস্তটাই বিশাল শূন্যস্থান, যা শিব বলে উল্লেখ করা হয় | এই সেই গর্ভ যার থেকে সবকিছুর  জন্ম হয়, এবং এই সেই বিস্মৃতি যার মধ্যে সবকিছু ফিরে যায়। সবকিছু শিব থেকে আসে এবং শিব-এ ফিরে যায়।

শিব শব্দের উপত্তি শী-ধাতু(শয়ন)থেকে।তার মানে, সবাই এবং সব কিছু যার মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত, যিনি সবারই আশ্রয়। আর বিশ্বব্রহ্মান্ড সমস্থ কিছুর আশ্রয় অর্থ্যা পরমব্রহ্ম স্বরূপ অর্থ্যা নিরাকার ঈশ্বর।যিনি সমস্থ গুনের (ব্যাক্তিত্বের)আধার। এই দর্শন কে ভালো ভাবে বোঝার জন্য শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদের মূল ভাবার্থ বুঝতে হবে।

(শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদ)

শঙ্করাচার্য্য বিশ্বসত্তাকে অবিভাজ্য এবং এক কল্পনা করেছেন বলেই তাঁর মতবাদকে অদ্বৈতবাদ বলা হয়| তিনি শিক্ষা দিলেন – ব্রহ্ম সত্য জগ মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ – অর্থা ব্রহ্ম সত্য, এই বিশ্ব মিথ্যা এবং জীবাত্মা ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন| এই যে জগ প্রত্যক্ষ হচ্ছে যা পরিবর্তনশীল এবং যা নাম ও রূপ এই দুয়ের সমন্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা ভ্রম মাত্র যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম| এই ভ্রম ব্রহ্মের মায়াশক্তির প্রভাব। একই কথা উল্লেখ আছে

শ্রীমদভগবদগীতা ১৮.৬১

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।

ভ্রাময়ন সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়রা ।।

হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।

অর্থা আমাদের এই ভ্রম বা ভুলের কারণ হল মায়া| এই মায়া তত্ত্বও অদ্বৈতবাদের একটি অবিভাজ্য অংশ| এইজন্য এই মতবাদকে মায়াবাদ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে|

শঙ্করাচার্য্যের মতে ব্রহ্ম সকল অবস্হাতেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ অর্থা ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়| কোন অবস্হাতেই তিনি বহু নন| ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে জগ তা ব্রহ্ম হতে পৃথক নয়; তাকে আমরা ভুল করে বহু আকারে দেখি| শঙ্করাচার্য্যের মতে এই যে দেখার ভুল তার কারণই হল মায়া| মায়া শক্তিটির এমনই ক্ষমতা আছে যা আসল জিনিষটির প্রকৃত রূপকে আবৃত করে রাখে এবং তার বিকৃত রূপটিকে প্রকট করে| সুতরাং দৃশ্যমান বিশ্ব ব্রহ্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত, তাই ব্রহ্ম| কিন্তু তাঁকে দেখার ভুলে আমরা বহুরূপে দেখি| শঙ্করাচার্য্য ব্যাখ্যা করেছেন যে ক্ষর হল জীবজগ| এর সর্বদা ক্ষরণ বা ক্ষয় হচ্ছে| আর অক্ষর হল কূটস্হ – জগতের সব কিছুর উপত্তির বীজ| শঙ্করাচার্য্যের মতে এটিই মায়া| এই কারণ-রূপিণী মায়া আর কার্য্যরূপী জীবজগতের উপরে আছেন উত্তম পুরুষ যিনি পরমাত্মা| শঙ্করাচার্য্যের মতে অজ্ঞানতাই হল দ্বৈতভাবের উপাদক| এই দ্বৈতভাব হতেই সকল কর্ম হয়| দ্বৈতভাব নাশ হলেই নিষ্ক্রিয় আত্মা প্রতিষ্ঠিত হয় আর তাহলেই কর্মসন্ন্যাস হয়| তখনই মানুষের আত্মজ্ঞান লাভ হয়, আর এই আত্মজ্ঞানকে মোক্ষ বলে। একই জিনিস গীতায় উল্লেখ আছে-

শ্রীমদভগবদগীতা ৫.১৭

তদ্বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তপরায়ণাঃ ।

গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ ।।

“যাঁর বুদ্ধি পরমেশ্বর প্রতি উন্মুখ হয়েছে, মন তার চিন্তায় একাগ্র হয়েছে, নিষ্ঠা পরমেশ্বরে দৃঢ় হয়েছে এবং যিনি তাকে তাঁর একমাত্র আশ্রয় বলে গ্রহন করেছেন, জ্ঞানের দ্বারা তাঁর সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিধৌত হয়েছে এবং তিনিই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছেন বা মোক্ষ লাভ করেছেন”

শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল। তাই প্রতিটি মঙ্গলময় জিনিস বা ব্যাক্তিত্ব হল শিবস্বরূপ। আর মঙ্গলকে আশ্রয় না করে কইজন বাঁচতে পারে? তাই শিব সবারই আশ্রয়স্থল। তেমনি শিব ব্যাক্তিত্বের ব্যাক্তি মঙ্গলময় ও আশ্রয়দাতার প্রতিক।

 

তাহার নাম ভূতেশ, ভূতভাবন।এখানে ভূত মানে “কাল” অর্থ্যা যিনি বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতেও থাকবেন। তাইতো তিনি ভূতনাথ অর্থ্যা জীব আত্মা যা চিরন্তন সত্য ও শাশ্বত তার প্রভু।

 

অর্থা , এক অর্থে ব্রহ্মেরই আরেক গুনবাচক নাম হলো শিব।

শাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)

পরমব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমরা স্থূল দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিভক্ত করে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি এবং এই তিনটি সত্ত্বাকে আলাদা আলাদা তিনটি রূপ দান করেছি। প্রকৃতপক্ষে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, এগুলো জাস্ট তিনটি নাম এবং এই তিনটি নাম পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র।

ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী। ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি যখন যে কাজ করেন, তখন সেই রূপের নামে কাজটি করেন, সেই তিনটি নামই হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।

এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন যে, বিষ্ণু হলো পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিষ্ণুর আংশিক অবতার রাম কি যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? কৃষ্ণ কি ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? কৃষ্ণ, পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকাররা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তারই নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তারই নাম বিষ্ণু এবং যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তারই নাম শিব বা মহেশ্বর; যে কথা বলা আছে গীতার এই শ্লোকে-

“অবিভক্তংচ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।

ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।”

অর্থ- পরমেশ্বরকে যদি যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবু তাঁকে সংহার কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

এতক্ষণে পাঠক-পাঠিকাদেরকে নিশ্চয় এটা বোঝাতেপেরেছি যে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কেউ নয়, তারা একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ।

একটু আগেই বলেছি, আমাদের শাস্ত্রকাররা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র।

তার মানে আমাদের মুনি ঋষিরা- বিশ্বের সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের থিয়োরিকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রকৃতি রূপ ঈশ্বর বা ব্রহ্মকে সর্বশক্তিমান হিসেবে ধরে নিয়ে, তার প্রধান তিনটি রূপ- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এবং তার পরবর্তী অন্যান্য দেব-দেবীগুলোকে কল্পনা করে নিয়েছেন মাত্র। এই বহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেব-দেবী কোনো দিনই বাস্তব পৃথিবীতে ছিলো না, তাই তাদেরকে নিয়ে যেসব পৌরাণিক গল্প, তা কোনো দিন পৃথিবীতে ঘটে নি; আমাদের শাস্ত্রকাররা, বিভিন্ন দেব-দেবীকে নিয়ে যেসব গল্প লিখেছে, তার মূল কারণ সেই সব গল্পের মাধ্যমে লোকশিক্ষা দেওয়া।

তাহলে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, দেব-দেবীরা যদি বাস্তব পৃথিবীতে কখনো না এসে থাকে, তাহলে তাদের কি কোনো শক্তি নেই ? অবশ্যই আছে। কোনো অঙ্কের সমাধানের জন্য আমরা যেমন এক্স ওয়াই জেড ধরে নিই, যদিও সেই অঙ্কের মধ্যে এক্স ওয়াই জেড নাই, কিন্তু অঙ্কের সমাধানের পর আমরা কিন্তু এক্স ওয়াই জেড এর একটি মান ঠিকই পাই, যেটা ঐ অঙ্কের ক্ষেত্রে এক্স, ওয়াই, জেড এর মান বা শক্তি। তেমনি বিশ্বের সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের মহাজটিল অঙ্কের সমাধানের জন্য আমাদের মহাগণিতবিদ মুনি-ঋষিরা, এক্স-ওয়াই-জেড রূপ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাদের যে মান বা শক্তি পেয়েছেন, তাহলো- ব্রহ্মা= সৃষ্টি, বিষ্ণু= পালন, শিব= ধ্বংস এবং এরকম আরো ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের মুনি ঋষিরা পৃথিবীর প্রত্যেকটি শক্তিসত্তাকে কোনো না কোনো দেবতা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। যেমন- বাতাসের যে শক্তি, সেটা একজন দেবতা, নাম পবনদেব। জলের শক্তি বরুনদেব। আগুনের শক্তি অগ্নিদেব। মাটির যে শক্তি, সেও একজন দেবী, মাতা বসুন্ধরা। এই ভাবে প্রকৃতির সব শক্তিই হিন্দুদের কোনো না কোনো দেব-দেবীরূপে পূজিত। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিশালী প্রাণীও হিন্দু দেব-দেবীদের সহযোগীশক্তি, যেমন- সিংহ, হাতি, ময়ূর, ইঁদুর, হুনুমান ইত্যাদি। প্রকৃতির যে সকল শক্তির মাধ্যমে আমরা টিকে থাকি, সেই সকল অদৃশ্য ও দৃশ্যমান শক্তি, এই ভাবে হিন্দু শাস্ত্রে পূজিত বা শ্রদ্ধার পাত্র।

প্রকৃতিতে প্রভাব বিস্তার করা- আগুন, জল, বায়ুর মতো শক্তিগুলোকে বাদ দিয়ে অন্যান্য যে শক্তি বা দেব-দেবীর কথা হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়, সেগুলো যে আমাদের মুনি-ঋষিদের ধরে বা কল্পনা করে নেওয়া, আশা করছি- সেই বিষয়টি এখন পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। এর সাথে আরো একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার যে, পৃথিবীতে যার জন্ম হয় নি, তার দুটি জিনিসের কখনো প্রয়োজন হবে না, সে দুটি জিনিস হলো খাদ্য ও যৌনতা। অবতারগণ পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, তাই তাদের খাদ্যের ও যৌনতার প্রয়োজন ছিলো। এই জন্যই রাম, কৃষ্ণ- খাবার খেয়েছেন এবং বিয়ে করেছেন এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু যে শিবের কখনো পৃথিবীতে জন্মই হয় নি, তার খাবারের প্রয়োজন হবে কেনো ?

- পরশুরাম, রাম, বলরাম, কৃষ্ণ, এরা পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, তাই এদের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কালী, কার্তিক, গণেশ- এদের কি কখনো মৃত্যু হয়েছে ? এদের মৃত্যু সম্পর্কে কি আপনি কিছু জানেন বা বলতে পারবেন ? পারবেন না। কারণ, আগেই বলেছি, যারা পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি, তাদের যেমন খাদ্যের ও যৌনতার প্রয়োজন হবে না, তেমনি তাদের কখনো মৃত্যুও হবে না। অবতারগন ছাড়া কোনো দেব-দেবীর মৃত্যুর কোনো ইতিহাস বা ঘটনা নেই, এই ঘটনা ই প্রমান করে যে, পৃথিবীতে তারা কখনো এবং কোনোদিনই ছিলেন না।

এবার নিশ্চয় প্রমাণিত যে, শিব পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি; তাহলে যে পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি, তার কোনো খাদ্যের প্রয়োজন হবে না, যেটা আগে বলেছি। তাহলে শিবের গাঁজা খাওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে ?

এবার শাস্ত্র থেকে বোঝা যাকঃ

 

সনাতন ধর্ম্মে বহুল প্রচলিত একটা (মিসকনসেপসন) বা ভ্রান্ত ধারণা হল ৩৩কোটি দেবতা। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় হলে দেবতা ৩৩ কোটি হয় কি করে! প্রকৃত ব্যপারটা দেখে নেয়া যাক-

দুইটি দৃষ্টিকোন থেকে আলোচনা করব। একটা হল "কোটি" শব্দটির অর্থ নিয়ে। আরেকটা হল "দেবতা" শব্দটা নিয়ে।প্রথমেই কোটি শব্দটি নিয়ে বলি। কোটি অর্থ প্রচলিত বাংলায় Crore হলেও সংস্কৃত ভাষায় তার অর্থ"ধরন" বা "প্রকার"।। মুল সংস্কৃত শব্দটি হল দেব্ যার অর্থ শক্তি।অর্থাত্‍ঈশ্বরের ৩৩ধরনের শক্তি।

এ বিষয়ে প্রথমেই যজুর্বেদ এর একটি মন্ত্র দেখে নেয়া যাক-

“ত্রয়স্ত্রিং শতাস্তুবত ভুতান্য শাম্যন্ প্রজাপতিঃ।

পরমেষ্ঠ্যধিপতিরাসীত্‍।।” -যজুর্বেদ ১৪.৩১

অনুবাদ:- যাঁহার প্রভাবে গতিশীল প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রজার পালক, সর্বব্যপক ,অন্তরীক্ষে ব্যপ্ত, তাঁহার মহাভূতের তেত্রিশ প্রকার গুনের স্তুতি কর।

এখন তেত্রিশ ধরনের শক্তির ব্যখ্যা দেখা যাক -

শতপথ ব্রাহ্মন ১৪.৫ এ যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি শাকল্যকে বলছেন-দেব ৩৩টি যা পরমেশ্বরের মহিমার প্রকাশক।

মনুসংহিতা ও বৃহদারন্যক উপনিষদ এ এর বিস্তারিত বর্ননা দেয়া আছে।

বৃহদারন্যক উপনিষদ ৩.৯.২-১১

"বিদগ্ধ শাকল্য যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞেস করলেন,হে যাজ্ঞবল্ক্য দেব(শক্তি) কয়টি? যাজ্ঞবল্ক্য বললেন ৩৩টি। তখন, শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন এই ৩৩টি দেব কি?

যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - ৮ বসুগণ:-অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরীক্ষ, আদিত্য, দ্যৌ

চন্দ্র, নক্ষত্র ।

১১ রুদ্র হল :-প্রান(নিশ্বাস), অপান(প্রশ্বাস), ব্যন, সমান, উদাম

, কুর্ম্ম, কৃকল, দেবদত্ত, ধনন্জয়, এবং জীবাত্মা ।

১২ আদিত্য হল ১২মাস, ইন্দ্র, প্রজাপতি অর্থাত্‍ মোট ৩৩টি। ইন্দ্র হল বিদ্যুত্‍ আর প্রজাপতি হল যজ্ঞ(যে কোনশুভ কর্ম)। তখন শাকল্য আবার জিজ্ঞেস করলেন তাহলে ৬টা দেব কি কি? তখন তিনি উত্তর দেন - অগ্নি,পৃথিবী, বায়ু,অন্তরীক্ষ, আদিত্য,দ্যুঃ। তখন তিনি বললেন তাহলে ৩টি দেব কি? তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন তিনলোক (ভ্যু,দ্যু,অন্তরীক্ষ)।

তারপর শাকল্য আবার বললেন সেই দুইটি দেব কি কি? খাদ্য এবং প্রান-উত্তর দিলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তখন আবার শাকল্য জিজ্ঞেস করলেন সেই দেড়টি কি? তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন যিনি প্রবাহিত হন। তখন শাকল্য বললেন সেই এক এবং অদ্বিতীয় যিনি প্রবাহিত হন তাঁকে আপনি কিভাবে দেড় বললেন? তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন যখন তা প্রবাহিত হয় তখন ই সবকিছু উত্‍পন্ন হতে শুরু করে। তাহলে কে সেই এক? প্রান!!! হ্যঁ প্রান (পরমাত্মা) সেই এক এবং অদ্বিতীয় দেব যাকে সবাই তত্‍বলে জানে"

অসাধারন এই শৈল্পিক ও গভীর দার্শনিক কথোপকথন ব্যখ্যা করছে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরব্রহ্ম থেকে সবকিছু উত্‍পন্ন হতে শুরু করে। একে একে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, ভু, দ্যু এবং অন্তরীক্ষলোক, বিদ্যুত্‍শক্তি সবকিছুই তার থেকে তৈরী হয় যাদেরকে ৩৩টি ভাগে ভাগ করা হয় এবং এদেরকে বলা হয় দেব অর্থাত্‍ শক্তি। আর দিনশেষে শক্তি একটাই যা থেকে সকল কিছু আপাতশক্তি প্রাপ্ত হয়। আর এই শক্তিই এক এবং অদ্বিতীয় পরমাত্মা।

 

এবার নিশ্চয় প্রমাণিত যে, শিব পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি; তাহলে যে পৃথিবীতে জন্ম নেয় নি, তার কোনো খাদ্যের প্রয়োজন হবে না, যেটা আগে বলেছি। তাহলে শিবের গাঁজা খাওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে ?

 

এবার আসা যাক  শিবমূর্তির প্রসঙ্গেঃ

 

অন্য এক স্তরে, যখন আমরা "শিব" বলি, আমরা নির্দিষ্ট এক যোগী, আদিযোগী  বা প্রথম যোগী, এবং, আদী গুরু, অর্থা প্রথম গুরুর উল্লেখ করছি, যিনি আজ যোগ বিজ্ঞান হিসাবে আমরা যা জানি, তার উস।

যোগ হলো আপনার মাথার উপর দাঁড়ানো বা আপনার শ্বাস ধরে রাখা নয়। যোগ হলো কীভাবে এই জীবনটা তৈরি হয় এবং কীভাবে এইটাকে তার চূড়ান্ত সম্ভাবনায় নিয়ে যাওয়া যায়, তার প্রকৃতি জানার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

 

যোগ বিজ্ঞানের প্রথম প্রসারণ হয়েছিল কান্তি সরোবরের তীরে, হিমালয় অঞ্চলের কেদারনাথের কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এক হিমবাহ হ্রদ,

যেখানে আদিযোগী তার প্রথম সাতজন শিষ্যদের জন্য এই অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির একটি নিয়মিত শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন, যাঁরা আজ সপ্ত  ঋষি বলে সুপ্রসিদ্ধ |

 এসব ঘটেছিলো কোনো ধর্মের জন্মের আগে । মানুষ মানবতা শেষ করে ফেলার বিভক্তিকর উপায় তৈরি করার আগেই,যা ঠিক করা অসম্ভব মনে হয়,মানব বোধশক্তি বাড়াতে প্রয়োজনীয় এই শক্তিশালী পদ্ধতিগুলোর উপলব্ধি ও প্রচার করা হয়।

 

সুতরাং "শিব" "যা নয় সেটা" এবং আদিযোগী উভয়কেই বোঝায়, কারণ অনেক ভাবেই তারা সমার্থক। এই  সত্তা, যে একজন যোগী  এবং সেই সত্তাহীনতা, যা অস্তিত্বের ভিত্তি, উভয়ই এক, কারণ কাউকে যোগী বলা মানে তিনি নিজের মধ্যে অস্তিত্বকে অনুভব করেছেন। একটা মুহুর্তের জন্যেও যদি আপনাকে নিজের মধ্যে শূন্যতা ধরে রাখা অনুভব করতে  হয়,তবে আপনাকে  সত্তাহীন হতে হবে। শুধুমাত্র শূন্যতা সবকিছু ধরে রাখতে পারে।

 অল্পকিছু সবকিছুকে ধরে রাখতে পারে না। একটা পাত্র সমুদ্র ধরে রাখতে পারে না। এই গ্রহ একটা মহাসাগরকে ধরে রাখতে পারে, তবে এটা সৌরজগতকে ধরে রাখতে পারে না। সৌর জগ এই কয়েকটা গ্রহ এবং সূর্যকে  ধরে রাখতে পারে, তবে এটা বাকি  ছায়াপথকে  ধরে রাখতে পারে না। আপনি যদি এরকম ক্রমশ যান, তবে অবশেষে আপনি দেখবেন কেবলমাত্র  শূন্যই সমস্তকিছু ধরে রাখতে পারে। "যোগ" শব্দটার অর্থ "মিলন "। তিনিই যোগী যিনি এই মিলনের অনুভব অর্জন করেছেন। তার মানে, অন্তত এক মুহুর্তের জন্যে হলেও, তিনি সম্পূর্ণ শূন্যতা অনুভব করেছেন।

 

যখন আমরা শিব কে "যা নয় সেটা" বা যোগী বলে উল্লেখ করি, এক অর্থে তাঁরা সমার্থক, কিন্তু তবুও তাঁরা দুই ভিন্ন বৈশিষ্ট। কারণ ভারত একটি তর্কমূলক সংস্কৃতি, আমরা এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় অনায়াসে যাতায়াত করি ।

 এক মুহুর্তে আমরা শিবকে  সর্বোত্তম বলি, পরের মুহূর্তে আমরা শিবকে এমন এক মানুষ হিসেবে জানি যিনি আমাদের যোগের এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি দিয়েছেন।

 

মহাদেব বা শিব বলতেই আমাদের চিত্তজগ একটি মূর্ত্তির উদয় হয় যিনি যোগাসনে উপবিষ্ট, বাঘের ছাল পরিহিত, ত্রিশুল ও ডমরুধারী, গলায় তার সাপ ইত্যাদি।

 

ভারতে এক সুবিপুল জনসমাজ শৈবকৃষ্টির অনুশীলন নিয়ে চলেছে।

 

পৌরাণিক সকল দেবতার মূর্তি আসলে বাস্তব জীবনে একটি নির্দিষ্ট ব্যাক্তিত্বের প্রতিক । ইস্টা,সাধনা,কর্ম ও লোকসেবার ইত্যাদি ভিতর দিয়ে যারা দীপ্তিমান চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠেছেন তারা মানুষের মধ্যে দেবতা বলে পরিগণিত হয়েছেন।

শিবমূর্তি তেমনি কতগুলি নির্দিষ্ট ব্যাক্তিত্বের সমাহার, আর যারা সঠিক ভাবে শিবভক্ত হন তাদের মধ্যে এইসব ব্যাক্তিত্বের প্রকটতা গুলি সুন্দর ভাবে দেখা যায়।

 

বৈদিক ও পরবর্তী কোনও শাস্ত্রেই শিবের এই 'নেশাখোর' চরিত্র উল্লিখিত নেই। পুরাণেও শিবকে এমন আলোয় দেখা হয়নি। সেদিক থেকে দেখলে, শিবের এই চিত্রণ একান্ত ভাবেই মানবিক কল্পনাপ্রসূত।

 

তবে কেন শিব পূজায় গাঁজা দেওয়ার প্রচলন গড়ে উঠল?

 

এর উত্তর খুঁজতে গেলে প্রবেশ কগরতে হবে শৈব দর্শনে।

শৈব শাস্ত্র অনুযায়ী, শিব যাবতীয় মায়ার ঊর্ধ্বে। তিনি পরাজ্ঞান। তাঁকে জানতে পারলেই বিশ্বরহস্যের অবসান ঘটে। সেদিক থেকে দেখলে মায়াকে শিবের পায়ে সমর্পণ করাই বিধেয়।

১৫০০ শতাব্দীর দিকে  রতিদেব, রামরাজা, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, রামচন্দ্র কবিচন্দ্র ও শঙ্কর কবিচন্দ্রের মতো কবিরা শিবায়ন কাব্য রচনা করে শিবের মায়া শোষনকারী ব্যাখা করতে গিয়ে তাকে গাঁজাখোর বলে উল্লেখ করেছেন।

সেই থেকে মানুষের মধ্যে এই ধরণের ধারনার সূচনা হয় যে শিব গাঁজা খেতেন । এমনকি  নাটক বা ছবিতে দেখা যায় নন্দী এবং ভৃঙ্গী শিবের কাছে বসে সিদ্ধি ও গাঁজা টানছে, আপনাদের মতে বলে যিনি মঙ্গলের প্রতিক তার দুই অনুচর আনন্দ,ভরণ, পোষণ ও ধারণ করার প্রতিক, তারা কিনা সিদ্ধি ও গাঁজা খাচ্ছে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ?

এখানে সিদ্ধি ও গাঁজা হল কর্মের কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদের প্রতিক যা কোনো মাদক দ্রব্যে নয়।

নন্দী আনন্দদায়ীর কারক ও ভৃঙ্গী যা ভরণ-পোষণের কারক, এই দুই বিহিত ব্যাবহার ও অনুশীলনের ভিতর দিয়েই জেগে ওঠে কার্যসিদ্ধির সৌন্দর্য্য।আর প্রকৃত শিব-ব্যাক্তিত্বই হল কার্যসিদ্ধির উস।

তাই তো প্রকৃত শিব-ব্যাক্তিত্ব বিশিষ্ট্য ব্যাক্তি কর্মের কৃতার্থ হওয়ার এবং যোগ/ ধ্যানের দ্বারা পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদ কে সেবন করে নেশাগ্রস্থ আনন্দ লাভ করে কোনো সিদ্ধি ও গাঁজা টেনে নয়।

 

 যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কৃতি মায়াকে নেশারই রূপভেদ বলে গণ্য করেছে। তাই কবি রামেশব্র মায়ার পর্দা ভেদ করেই সত্য প্রকট হয় বলে মনে করেছে। সেক্ষেত্রে গাঁজা বা অন্য নেশার বস্তু মায়ার প্রতীক হিসেবেই প্রতিভাত।

এই বস্তু দেবাদিদেবকে সমর্পণ করে মায়ার নাগপাশ মুক্ত হতে চায় মানুষ। এখান থেকেই শিবকে গাঁজা বা সিদ্ধি নৈবেদ্য প্রদানের পরম্পরা তৈরি হয় বলে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের গবেষকরা মনে করেন।

 

শিবের গাঁজা খাওয়ার ভ্রান্ত ধারণা যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছেঃ

আমাদের মুনি-ঋষিরা ধ্যান করতেন। ধ্যান আসলে গবেষণা। এই ধ্যান বা গবেষণা করতে গিয়ে আমাদের মুনি-ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন, প্রকৃতির লক্ষ লক্ষ গাছ পালার মধ্যে রয়েছে অজস্র ভেষজ বা ঔষধি গুন। থেকেই তারা আবিষ্কার করেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র, যা পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসা জ্ঞান। এই চিকিৎসা জ্ঞান বেদের অংশ বলেই এর নাম আয়ুর্বেদ। অর্থা বেদ এর যে জ্ঞান মানুষের আয়ু বাড়ায় তাই আয়ুর্বেদ। এই আয়ুর্বেদ বলছে, গাঁজার রয়েছে অসংখ্য ঔষধি গুন, যা স্বল্পমাত্রার ব্যবহারে মানুষ তার উপকার পেতে পারে

কিন্তু গাঁজা খেলে যেহেতু একধরণের নেশা হয় এবং মানুষ এটা বার বার খেতে বাধ্য হয়, তাই আধুনিক যুগ শুরু হলে, অনেকেই এটাকে মাদক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে এবং এটা এবং এর সেবনকারীরা, সমাজে একেবারে ঘৃণিত না হলেও তারা সমালোচনার পাত্র হয়ে পড়ে।

স্বল্প পরিমানের গাঁজা খাওয়ার যে বিজ্ঞানভিত্তিক কী উপকারিতা, সেটা আমি একটু পরেই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো; কিন্তু গাঁজা খেলে যে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কাজে বা কোনো বিষয়ে গভীর মনোযোগের সৃষ্টি হয় বা গাঁজা সেবনকারী কোনো বিষয়ে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে পারে, এটা কিন্তু বাস্তবভাবে প্রমাণিত। এজন্যই আমাদের মুনি-ঋষিরা তাদের ধ্যান বা গবেষণায় মনোযোগ বৃদ্ধির সুবিধার্থে স্বল্প পরিমান গাঁজা সেবন করতেন

আমাদের মুনি ঋষিদের পরম্পরা হলো বর্তমানের সাধু-সন্ন্যাসী, এই পরম্পরা চলে আসছে প্রায় /১০ হাজার বছর আগে থেকে; তো মুনি ঋষিরা যা করতেন, তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আমাদের সাধু সন্ন্যাসীদের মধ্যে এখনও আছে। এই ভাবে সমাজ সংসার ত্যাগ করা, পাহাড় জঙ্গল শ্মশানে বিচরণকারী সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে গাঁজা সেবনের প্রচলন এখনও আছে এবং প্রাচীন বা মধ্যযুগেও ছিলো। কিন্তু মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের শুরুর দিকে যখন গাঁজাকে মাদক হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হলো, তখন সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো ব্যক্তি কেনো গাঁজা খায়, এই প্রশ্নের জবাবে আমাদের সাধু-সন্ন্যাসীরা বিব্রত হলো; কারণ, এর ভেষজগুন সম্পর্কে তাদের কোনো স্পষ্ট এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা ছিলো না, কিন্তু তারা যেহেতু খায় এবং তাদেরকে যেহেতু এটা খেতে হবে, তাই আত্মপক্ষ সমর্থন রে এটা সেবনের জন্য তারা বলে দেয়, আমাদের মহাদেব শিবও গাঁজা সেবন করতেন এবং শিবের বেশ ভূষা যেহেতু সাধু সন্ন্যাসীদের মতোই এবং সে সব সময় থাকে ধ্যানমগ্ন, সেহেতু শিবের সাথে গাঁজা সেবনের এই গল্প খুব সুন্দরভাবে মানিয়ে যায় এবং লোকজন তা বিশ্বাস করে ফেলে

এভাবেই সমাজে শিবের গাঁজা সেবনের গল্প ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তা মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুনাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাধ্যমে তা লোকমনে একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত রূপ পায়; কারণ, সেই কাব্যে বলা আছে, স্বয়ং শিবঠাকুর গাঁজা-ভাং খেয়ে কচুরিপানায় উপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়াতেন। এইসব বিবেচনা থেকেই বাংলা গান বানানো হয়েছে,

গাঁজার নৌকা পাহাড় বাইয়া যায়।

মূলত বন জঙ্গল পাহাড়ে বসবাসকারী বিচরণকারী আমাদের স্বল্পজ্ঞানী সাধু সন্ন্যাসীরা নিজেদের গাঁজা সেবনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য মহাদেব শিবের উপর এই কলঙ্ক লেপন করে এবং যেহেতু মনে করা হয় যে, সাধু সন্ন্যাসীরা শাস্ত্র পড়ে এবং তারা শাস্ত্র সম্পর্কে ভালো জানে এবং যেহেতু বেশ ভূষা ধ্যানমগগ্নতার দিক থেকে শিব হলো সাধু-সন্ন্যাসীদের রোল মডেল, সেহেতু জনসমাজে শিবের নামে গাঁজা খাওয়ার এই অপপ্রচার খুব সহজেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ছড়িয়ে পড়ে

যা হোক, অপপ্রচার করে যতই শিবের নামে গাঁজা খাওয়ার অপবাদ দেওয়া হোক, একটা প্রশ্নে এই থিয়োরি সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়বে, আর তা হলো, পৃথিবী যে শিব জন্ম নেয় নি, তার খাবারের প্রয়োজন হবে কেনো ? আর যদি কেউ বলে, পৃথিবীতে শিব ছিলেন। তখন তাকে প্রশ্ন করবেন, তাহলে সেই শিব মরলেন কোথায় এবং কিভাবে ? ব্যস, দেখবেন সব চুপ

আমাদের মুনি-ঋষিরা তাদের ধ্যান বা গবেষণায় গাঁজার উপকারিতা সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন আমাদের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে; আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের সেই কথাই নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায়, এবার নজর দেওয়া যাক সেই দিকে

গাঁজা, পুরুষের বন্ধ্যাত্বকে দূর করে:

হ্যাঁ,এমনই অবিশ্বাস্য কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গাঁজার নেশা করলে তা গিয়ে প্রভাব ফেলে ব্রেনের ক্যানাবিনয়েড রিসেপটরে, এই ক্যানাবিনয়েড রিসেপটরে গাঁজার ধোয়া যখন তা পৌঁছায় তখন তা স্পার্ম ৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এইভাবে সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম পুরুষদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাঁজা ফলদায়ক। ডিটেইলস রিপোর্টি দেখত হলে ক্লিক করুন নিচের এই লিঙ্কে:

http://zeenews.india.com/.../marijuana-can-help-in...

গাঁজা খেলে ভালো থাকে চোখ :

হ্যাঁ, এরকমই কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। গাঁজা খেলে রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তির উন্নতি হয়। কারণ, গাঁজার মধ্যে রয়েছে ক্যানাবিনয়েডস, যা অল্প আলোতেও দেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। গাঁজার উপর দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়েছেন কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল গবেষক। তাদের গবেষণাতেই উঠে এসেছে এই তথ্য। তারা বলেছেন, গাঁজার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আলো শনাক্তকরণ ক্ষমতা। মারিজুয়ানা বা গাঁজা বা ক্যানাবিস- রয়েছে ৫০০টি প্রাকৃতিক যৌগ। এরমধ্যে কমপক্ষে ৮৫টি যৌগ মিলে তৈরি করে ক্যানাবিনয়েডস। যারমধ্যে সবচেয়ে বেশি গুণসম্পন্ন হল THC বা টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল CBD বা ক্যানাবিনল। বিস্তারিত রিপোর্টটি পাবেন নিচের এই লিঙ্কে :

http://zeenews.india.com/.../marijuana-can-cause-this...

গাঁজা প্রতিরোধ করে অ্যালঝেইমারস :

বয়স হলে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার রোগ অ্যালঝাইমার এর উদাহরণ রয়েছে সারা বিশ্বে। ডায়বেটিস, ওবেসিটির মতোই বর্তমান সময়ের অন্যতম দুঃশ্চিন্তার বিষয় অ্যালঝাইমার। এই অসুখের চিকিৎসা এখনও অজানা বিশ্বের কাছে। তবে সম্প্রতি জানা গিয়েছে গাঁজার মধ্যে খুব কম পরিমানে থাকা ডেল্টা-- টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল বা টিএইচসি রুখে দিতে পারে অ্যালঝাইমারকে

ইউনিভার্সিটি অফ সাইথ ফ্লোরিডার নিউরোসাইন্টিস্টরা জানাচ্ছেন বয়স্ক মস্তিষ্কের অ্যামাইলয়েড বিটার পরিমান কমিয়ে দিতে পারে গাঁজা সেবন। গবেষকরা বলেন খুব কম পরিমানে গাঁজা সেবনের ফলে ধরে রাখা যাবে স্মৃতিশক্তি। গবেষকরা এখন টিএইচসি- মধ্যে ড্রাগ ককটেলের ব্যবহার নিয়ে গবেষনা করছেন।

দেখুন, জার্নাল অফ অ্যালজাইমারস ডিজিসে প্রকাশিত হয়েছে গবেষনার রিপোর্ট।

http://zeenews.india.com/.../marijuana-can-beat-aljhimers...

এছাড়াও দেখুন, গবেষকরা বলছেন পরিমাণমতো গাঁজা ওষুধ হিসেবে সেবন করলে নাকি অনেক উপকার৷ বিজ্ঞানীদের বাতলে দেওয়া এমনই নয়টি উপকার তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে !

মৃগীরোগ কমায় :

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০১৩ সালেই জানিয়েছেন, মারিজুয়ানা বা গাঁজা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিলে মৃগী বা এই ধরণের কিছু স্নায়ুরোগ থেকে দূরে থাকা যায়৷ বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী জার্নাল অফ ফার্মাকোলজি অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল থেরাপিউটিক্সে ছাপাও হয়েছে তাদের এই গবেষণালব্ধ তত্ত্ব৷

গ্লুকোমা দূরে রাখতে সহায়তা করে :

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আই ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, মারিজুয়ানা গ্লুকোমার ঝুঁকিও কমায়৷ গ্লুকোমা চোখের এমন এক রোগ যা চির অন্ধত্ব ডেকে আনে৷ এখানে মারিজুয়ানা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে, তা গাঁজারই আমেরিকান নাম

গাঁজা, ক্যানসারেরও অ্যানসার!

এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবেই স্বীকার করেছে৷ ২০১৫ সালে সেই দেশের ক্যানসার বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্যানসার অর্গ- জানানো হয়, মারিজুয়ানা অনেক ক্ষেত্রে টিউমারের ঝুঁকি কমিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধকেরও ভূমিকা পালন করে৷

কেমোথেরাপির ক্ষতি কম :

ইউএস এজেন্সি ফর ড্রাগ জানিয়েছে, মারিজুয়ানা ক্যানসার রোগীর রোগ যন্ত্রণা অন্যভাবেও কমায়৷ ক্যানসার রোগীকে এক পর্যায়ে কেমোথেরাপি নিতে হয়৷ কেমোথেরাপির অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া৷ মারিজুয়ানা কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত অনেক ক্ষতি লাঘব করে৷

স্ট্রোক কম হয় :

এটি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যামের গবেষকদের উদ্ভাবন৷ তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন, মারিজুয়ানা মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতেও সহায়তা করে৷ ফলে স্ট্রোক-এর ঝুঁকি কমে৷

গাঁজা মাল্টিপল সক্লেরোসিস বিরোধী:

মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের একটি বিশেষ স্তর ক্ষতিগ্রস্থ হলে মাল্টিপল সক্লেরোসিস বা এমএস নামের এক ধরণের স্নায়ুরোগ হয়৷ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মারিজুয়ানা সেবন করলে এই রোগের ঝুঁকিও কমে৷

ব্যথা নিরোধ :

ডায়াবেটিস চরম রূপ নিলে রোগীদের অনেক সময় হাত-পা এবং শরীরের নানা অংশে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়৷ ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বলছেন, ক্যানাবিস সেই যন্ত্রণা লাঘব করতে সক্ষম৷

হেপাটাইটিস সি- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমায় :

হেপাটাইটিস সি- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কমায় মারিজুয়ানা৷ নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধের মতো গাঁজা সেবন করিয়ে দেখা গিয়েছে এই রোগে আক্রান্তদের শতকরা ৮৬ ভাগেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক কমেছে

উপরের এই প্রতিবেদনটি যে আমার বানানো নয়, তার প্রমান পাবেন নিচের এই লিঙ্কে গেলে

http://www.chandpurweb.com/health/2016/04/21/25051

গাঁজা শরীরের বিষ-ব্যথা সারায়:

একটু আগেই অন্য একটা রিপোর্টে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছি, এখানে করছি বিস্তারিত। গাঁজার এই উপকারের কথার বর্ণনা রয়েছে ভারতবর্ষের প্রাচীন মধ্যযুগীয় চিকিৎসা শাস্ত্র অর্থা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বর্তমানে গাঁজা, ভাং মারিজুয়ানার ওপর গবেষণা করে জেনেছেন যে, সব দ্রব্য থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ব্যথানাশক ওষুধ প্রস্তুত করা সম্ভব, যা মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না। গবেষণাটি করেছে ফ্রান্সের বায়োমেডিকেল ইনস্টিটিউট। এর নেতৃত্ব দিয়েছে আইএনএসইআরএম। ফ্রান্সের গবেষকরা জানান, 'তারা ইঁদুরের মস্তিষ্কের যে অংশের কোষের নিউরনে গাঁজা বা মারিজুয়ানা ক্রিয়া করে তা ওষুধ প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করেন প্রথম। এর পর ওই ইঁদুরের শরীরে এসব পদার্থ প্রবেশ করিয়ে দেখা গেছে যে, তাতে ইঁদুরটি বেহুশ হয় না। বরং ওটির প্রাণচাঞ্চল্য ঠিকই থাকে। অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ব্যথানাশক হিসেবে গাঁজা বা মারিজুয়ানার ভালো গুণ মানুষের বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং অস্ত্রোপচারের জন্য চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। শিগগিরই গাঁজা মারিজুয়ানার নির্যাস থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ওষুধ প্রস্তুত হবে

গাঁজার ক্ষতি সিগারেটের চেয়ে কম :

যারা গাঁজাকে খুব নিম্নশ্রেণির নেশা বলে মনে রে সিগারেট ফুঁকেন, তাদের জন্য আছে দাঁত ভাঙ্গা জবাব। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দেখেছেন, ভাং গঞ্জিকা সেবনে ফুসফুসের ক্ষতি, তামাক পাতায় প্রস্তুত সিগারেটের চেয়ে কম

এই দুটি বিষয়ের উপর করা রিপোর্ট দেখতে পারেন, নিচের এই লিঙ্কে :

https://bn.wikipedia.org/.../%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%81...

গাঁজা সেবনকারীর হাড় জোড়া লাগে খুব তাড়াতাড়ি :

সম্প্রতি ইসরায়েলের একদল বিজ্ঞানী তাদের গবেষণায় দেখেছেন যে, গাজা সেবনকারীদের মধ্যে কারও হাড় ভেঙ্গে গেলে তা যারা গাজাসেবন করেন না তাদের চেয়ে দ্রুত জোড়া লাগে। পরীক্ষার অংশ হিসেবে গবেষকদল গাজায় থাকা নন-সাইকোঅ্যাকটিভ কমপাউন্ড ক্যানাবাইডিয়ল (সিবিডি) কিছু ইদুরের উপর পরীক্ষা করেন। গবেষকদলের গবেষক . ইয়াঙ্কেল গাবেত বলেন, আমরা দেখেছি যে সিবিডি হাড় জোড়া হতে এবং খুব দ্রুত ক্ষতস্থান সারিয়ে তুলতে বেশ কার্যকরীই শুধু নয়, অন্যান্য উপাদানের চেয়ে অধিক কার্যকরী। হাড়ের নতুন টিস্যু তৈরিতে এর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। সিবিডি মাধ্যমে একবার হাড় জোড়া লাগলে তা আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্ত হয়। গবেষকদলের মতে, মানবশরীর প্রকৃতিগত ভাবেই এন্ডোক্যানাবাইনয়েড ব্যবস্থা চালু রাখে যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মেরুদণ্ডের উপর কাজ করে। মানুষের মস্তিস্ক এবং শরীর ক্যানাবাইনয়েডের সংস্পর্শে আসলে স্বাভাবিকভাবেই সাড়া দেয়, তা সেটা আভ্যন্তরীন পর্যায়েই হোক অথবা গাজা সেবনের মাধ্যমেই হোক

এছাড়াও এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাজা রক্তচাপ সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রন করতে এবং এইচআইভি প্রতিহত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে

শুধু তাই নয় কয়েক প্রকার ক্যান্সার নিরাময়েও পর্যন্ত গাজা ভালো ফল দেয়। বিশেষ করে যারা লিওকোমিয়ায় আক্রান্ত, তাদের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিনই চিকিৎসকরা অনুমোদন সাপেক্ষে গাজা ব্যবহার করে আসছেন

যারা ভাবছেন গাঁজার যখন এতই উপকারিত তখন এটা এখনো কেনো নিষিদ্ধ মাদক ? তাদের জন্য বলছি

ইউরোপ, আমেরিকা আফ্রিকার অনেক দেশ ইতোমধ্যেই চিকিৎসাশাস্ত্রের খাতিরে গাজাকে বৈধতা দিয়েছে। গাজা বৈধকরণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি রাজ্য। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কলোরাডোতে প্রথম বৈধতা দেয়া হয়েছিল। এরপর কলোরাডোতে গাজা বৈধকরণের সফলতার পর অন্যান্য রাজ্যগুলোও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এর বাইরে নতুন করে চিলি তাদের দেশ গাজাকে শুধু বৈধতাই দেয়নি, প্রতিটি নাগরিক সর্বোচ্চ পাঁচটি গাজা গাছ লাগাতে পারবে সেই অনুমোদনও দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কানাডা, স্পেন, হল্যান্ড অস্ট্রিয়া মারিজুয়ানাকে ঔষধ হিসেবে গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। নিচে উইকিপিডিয়ার একটি লিঙ্ক দিয়েছি, সেখানে দেখতে পাবেন এই তথ্যটি

যা হোক, প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন মিথ বা সাহিত্যে গাজার ব্যবহার দেখা যায়। কোথাও নেশাদ্রব্য হিসেবে গাজার ব্যবহার দেখা যায়নি। এর ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় শাস্ত্রবিদেরা এবং অন্যান্য গবেষকরা দাবি করছেন যে, গাজার ক্ষতি নেই বরংচ রয়েছে শারিরীক লাভ। মানব শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে গাজা মহৌষধ হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু ভারতের সেকুলার সরকার, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের এই জ্ঞানকে পাত্তা না দিয়ে কেমিক্যালজাত মাদকের সাথে সাথে গাজাকেও মাদকের পর্যায়ভূক্ত করে এবং ১৯৮৫ সালে আইন করে গাজাকে অবৈধ ঘোষণা করে

এই রিপোর্টটি সত্য কিনা, তা যাচাই করতে চাইলে দেখুন লিঙ্কটি

http://www.24updatenews.com/bangla/article/17620/index.html

উপরে বলেছি, আমাদের মুনি-ঋষিরা গাঁজা সেবন করতেন, এটা শুনে যাদের কষ্ট হয়েছে বা মেনে নিতে পারেন নি, তাদের জন্য উইকিপিডিয়া বলছে,

হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতে হিন্দু শিখদের মাঝে এবং নেপালে কান্নাবিস গ্রহণের রেওয়াজ ছিল।এই বনজ উদ্ভিদের নাম ছিল সংস্কৃত ভাষায় গঞ্জিকা বা গাঁজা।

এটা যে শুধু হিন্দু মুনি-ঋষিরাই খেতো, তাই নয়, প্রাচীন কালের ইহুদি খ্রিষ্টানরা সেবন করতো এমন কি সেবন করতো, মামলুক আমলের মুসলিম সুফীরাও। দেখুন, উইকিতে কিভাবে বলা আছে এই কথা-

কান্নাবিসকে প্রাচীন ইহুদি ক্রিস্টানরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত। মামলুক সময়ে বিভিন্ন সূফী সম্প্রদায়রা কান্নাবিস গ্রহণ করত।

উইকির এই লিঙ্কটি দেখতে পারেন নিচে-

https://bn.wikipedia.org/.../%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0...

তাস খেলা একটি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মজাদার খেলা, কিন্তু এই খেলার সাথে যখন টাকা যুক্ত হলো অর্থা তাস খেলা যখন জুয়ায় পরিণত হলো, তখন সমাজ তাকে খারাপভাবে দেখতে শুরু করলো এবং যারা তাস খেলে, তারা সমালোচনার পাত্র হয়ে পড়লো। শুধু এই ভয়েই অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাস খেলে না। এটা কিন্তু তাসের দোষ নয়, দোষ মানুষের; যারা তাসকে খারাপভাবে ব্যবহার করা শুরু করেছিলো

একইভাবে উপকারী গাঁজাকে যারা নেশার দ্রব্যে পরিণত রে একে সমালোচিত করেছে, দোষ সেইসব মানুষদের, কোনোভাবেই গাঁজার নয়

অতিরিক্ত সব কিছুই খারাপ, এমনকি যদি অতিরিক্ত ভাত বা জল খাওয়া হয়, সেটাও খারাপ। তাহলে আপনি অতিরিক্ত গাঁজা খাবেন কেনো ? আপনার প্রয়োজনে এবং কার্য সিদ্ধির জন্য যতটুকু খাওয়া প্রয়োজন তাই খাবেন

আগুন খুব উপকারী, যতক্ষণ সেটা নিয়ন্ত্রণে থাকে; আর যেই সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, তখনই সেটা হয়ে উঠে বিধ্বংসী। তাই বলে কি আমরা আগুনকে ব্যবহার করছিনা ? না, আগুনের ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে আমরা আদিম যুগে ফিরে গিয়েছি বা যাবো ? একইভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে অবশ্যই গাঁজা ক্ষতিকর। যদি আমরা এর থেকে উপকার চাই, তাহলে অবশ্যই এটাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে ব্যবহার করতে হবে

শেষে একটা কথা না বললেই নয়, গাঁজার উপকারিতা নিয়ে পোস্ট লিখলাম বলে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আমি কাউকে গাঁজা খেতে ৎসাহিত করছি। শিব সম্পর্কে মুসলমানদের কটূক্তির জবাব দিতে গিয়ে, আমি শুধু প্রকৃত সত্যটাকে জানালাম, এখন এটাকে কে কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটা তার বা তাদের ব্যাপার

 

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, তিনে মিলে এক ঈশ্বর - কথাটির অর্থ কি???????

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব তিন জনের মিলিত শক্তিই হচ্ছে ঈশ্বর বা ভগবানআর ঈশ্বর হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব রুপে সমগ্র জগৎকে পরিচালনা করেনশ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মা রুপে সৃষ্টি করেন,বিষ্ণু রুপে পালন করেন এবং শিব রুপে ধ্বংস করেন

বিষ্ণু পুরাণে( //৬২) বলা হয়েছে, " একমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণই সৃষ্টি, স্থিতি লয় করিবার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু শিব এইরুপ সংজ্ঞা প্রাপ্ত হন"

তাই ১৪ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ঘোষণা করেছেন যে, তিনিই হলেন ব্রম্ম

ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য

শাশ্বতস্য ধর্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্য ১৪/২৭

(ব্রহ্মণঃ, হি, প্রতিষ্ঠা, অহম্, অমৃতস্য, অব্যয়স্য, ,

শাশ্বতস্য, , ধর্মস্য, সুখস্য, ঐকান্তিকস্য, ১৪/২৭

অর্থ:- অমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয় অব্যয় অমৃতের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের আমিই আশ্রয়

 

 ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর নারায়ণ ঈন্দ্র

নারায়ণ

নারায়ণ (সংস্কৃত: नारायण IAST: Nārāyaa) হলেন বৈদিক সর্বোচ্চ উপাস্য।[১][২] বৈষ্ণবধর্মে তাঁকে পুরুষোত্তম বা শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে করা হয়। তিনি বিষ্ণু বা হরি নামেও পরিচিত। বেদ, ভগবদ্গীতা,[৩] ও পুরাণেও তাঁকে পুরুষোত্তম বলা হয়েছে।

পরম উপাস্যের সর্বব্যাপী সত্ত্বাটি নারায়ণ নামে পরিচিত। তিনিই ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তে উল্লিখিত পুরুষ। যজুর্বেদের নারায়ণ সূক্তের পঞ্চম শ্লোকে নারায়ণকে ব্রহ্মাণ্ডের ভিতরে ও বাইরের সব কিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারায়ণ শব্দের অর্থ যিনি জলের উপর শয়ন করেন।  হিন্দুশাস্ত্র মতে, জল প্রথম সৃষ্ট বস্তু, তাই সৃষ্টিকর্তা নারায়ণ জলেই বাস করেন।[৪] এই জন্য হিন্দু শিল্পকলায় নারায়ণকে প্রায়শই জলের উপর অবস্থানকারী মূর্তিতে চিত্রিত করা হয়। সংস্কৃত ভাষায় নর শব্দের অর্থ মানুষ। তাই "নারায়ণ" শব্দের অন্য অর্থ হল, মানুষ যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করে।

ভাগবত পুরাণে নারায়ণকে বলা হয়েছে পরব্রহ্ম বা সর্বোচ্চ উপাস্য। এই পুরাণ মতে, তিনি অসংখ্য জগ সৃষ্টি করে প্রতিটি জগতে জগদীশ্বর রূপে প্রবেশ করেছেন।[৫]নারায়ণ ব্রহ্মা রূপে রজঃ গুণ অবলম্বন করে তিনি চোদ্দটি জগ সৃষ্টি করেছেন। বিষ্ণু রূপে সত্ত্ব গুণ অবলম্বন করে তিনি সেগুলি রক্ষা করেন এবং শিবরূপে তমঃ গুণ অবলম্বন করে তিনি তা ধ্বংস করেন।[৬][৭][৮] এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ত্রিমূর্তি ও নারায়ণঅভিন্ন।

নারায়ণের অপর নাম মুকুন্দ । এই শব্দের অর্থ, যিনি জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি অর্থা মোক্ষ প্রদান করেন।[৯]

জাগতিক বিশ্বের বাইরে নারায়ণের সর্বোচ্চ ও চিরন্তন অধিষ্ঠান বৈকুণ্ঠে। বৈকুণ্ঠকে হিন্দুরা আনন্দময় স্থান মনে করেন। বৈকুণ্ঠ পরমধামও (অর্থা, সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান যেখানে মুক্তাত্মারা পরমেশ্বেরের সান্নিধ্যে চিরকালের জন্য বাস করেন) বলা হয়। হিন্দুরা মনে করেন, বৈকুণ্ঠের ধারণা কোনো জাগতিক বিজ্ঞান বা যুক্তির সাহায্যে করা যায় না।[১০] কোনো কোনো ক্ষেত্রে, ক্ষীরসমুদ্র, যেখানে বিষ্ণু অনন্তনাগের উপর শয়ন করেন, তাকে জাগতিক বিশ্বের স্থানীয় বৈকুণ্ঠ বলা হয়।

মহাভারত-এ কৃষ্ণকে একাধিকবার নারায়ণ বলা হয়েছে ও অর্জুনকে নর বলা হয়েছে।[১১] এই মহাকাব্যে তাঁদের বোঝাতে বহুবচন কৃষ্ণদ্বয় শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বিষ্ণুর পূর্ববর্তী অবতার নর-নারায়ণের সঙ্গে তাঁদের একত্ব বোঝাতে।[১২]

ব্রহ্মা

ব্রহ্মা হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবতার একজন; অন্য দুজন&nbsp; বিষ্ণু ও&nbsp; শিব। বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ‘প্রজাপতি’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ঋগ্বেদসহ বৈদিক সাহিত্যের অন্যান্য গ্রন্থে ব্রহ্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। অনন্তশয্যায় শয়ান ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে তাঁর প্রকাশ। তিনি বৈদিক যজ্ঞের অন্যতম পুরোহিত এবং সাধারণত চতুর্মুখ, চতুর্ভুজ ও হংসবাহনরূপে কল্পিত। তিনি উন্নত দেহের অধিকারী এবং তাঁর গায়ের রং রক্তাভ গৌরবর্ণ। তাঁর চার হাতে থাকে কমন্ডলু, স্রক্, ঘৃতপাত্র বা পুস্তক এবং অক্ষমালা। বিবাহের লগ্নপত্রে, সূতিকাগৃহে, শিশুর জন্মের ষষ্ঠ দিনে এবং বাস্ত্তপ্রতিষ্ঠার সময় ব্রহ্মাকে স্মরণ করা হয়।<br>

কুম্ভকারের চক্রে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ব্রহ্মার পূজা হয়। এছাড়া বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও ব্রহ্মাপূজার আয়োজন করা হয়। পূজার স্বাভাবিক উপকরণের সঙ্গে বিশেষভাবে লাল ফুলের ব্যবস্থা থাকে। এ পূজার নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই এবং পূজার সময় ঢাক বাজানো হয় না। উপমহাদেশের বাইরেও চীন, জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা স্থানে ব্রহ্মার ভাস্কর্য লক্ষিত হয়। [সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়]

বিষ্ণু

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণু দেবতা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সর্ব্বোচ্চ দেবতা৷ বিষ্ণু দেবতা বিশ্বের দেবতা হিসেবে বিবেচিত হন৷ বিষ্ণুদেবতাকে পরমাত্মা কিংবা পরমেশ্বর হিসেবেও ঘোষণা করা হয়৷ বিষ্ণু দেবতার একাধারে রয়েছে দুটি দিক৷ বিষ্ণু দেবতার একদিকে রয়েছে যেমন শান্ত এবং স্নিগ্ধ রূপ৷ অপরদিকে তারও রয়েছে একটি ভয়ংকর রূপ৷ কালস্বরূপ শেষনাগের উপরে শুয়ে থাকেন তিনি৷

 

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, ভগবান বিষ্ণু সম্পর্কে লেখা রয়েছে, শান্তকারম ভুজগশয়নং৷ এই কথাটির মানে ভগবান বিষ্ণু শেষনাগের উপরে বিশ্রাম নেন৷ তবে, এখানেই একটি প্রশ্ন ওঠে৷ কিভাবে ভগবান বিষ্ণু সাপের রাজার উপর বিশ্রাম করেন? তবে, এখানেই উঠে আসে একটি বিষয়৷ বিষ্ণু ভগবান বলেই তাঁর রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা৷ এর পাশাপাশিই ভগবান বিষ্ণুর রয়েছে আরও বেশ কিছু ক্ষমতা৷ যেগুলি শুনবে আপনি চমকে যাবেন৷

 

প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে বিশেষ কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য৷ সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেককেই নানারকম কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ যেটিকে শেষনাগের সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে৷ বিষ্ণুদেবতার স্নিগ্ধ রূপ যেকোনও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সাহায্য করে৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, বিষ্ণুদেবতার প্রধান ভক্ত নারদ৷ যিনি নারায়ন নামেও পরিচিত৷ এরপর থেকেই ভগবান বিষ্ণুর প্রতিটি নামের পরই নারায়ন নামটি নেওয়া হয়ে থাকে৷ উদা:স্বরূপ বলা যায়, সত্যনারায়ন, অনন্তনারায়ন, লক্ষ্মীনারায়ন, শেষনারায়ন ইত্যাদি৷ কথিত আছে, ভগবান বিষ্ণুর পা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল গঙ্গা নদীর৷ জলের ওপর নাম নীর বা নার৷ এই নামটির সৃষ্টি হয়েছে এই নারায়ন নামটি থেকেই৷

মহেশ্বর

শিব হল হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবতার অন্যতম৷ শিবই হল শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা৷ যোগ,ধ্যান এবং শিল্পকলার দেবতা শিবকে ভয়ংকর রূপে শক্তিশালী দেবতা রূপে বর্ণনা করা হয়৷ হিন্দু ধর্মে শিবের উল্লেখ রয়েছে বিনাশকারী শক্তিরূপে৷ হিন্দুধর্মে এই শিব ঠাকুরের বেশ কিছু নামও রয়েছে৷ এই নামগুলি হল- মহাদেব, মহাযোগী, পশুপতি, নটরাজ, ভৈরব, বিশ্বনাথ এবং ভোলেনাথ৷ এই শিব ঠাকুরকে ঘিরেই রয়েছে আরও বেশ কিছু ঘটনা৷ যা অনেকেরই অজানা৷

১) হিন্দু দেবতার মধ্যে তিন শক্তিশালি দেবতার মধ্যে রয়েছে ভগবান বিষ্ণু, ব্রহ্মা এবং শিব৷ এদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে শিব ঠাকুর৷ এই ঠাকুরের রয়েছে দুই রূপ৷ একাধারে তিনি যেমন পার্বতীর স্বামী৷ অপরদিকে তিনিই আবার কৈলাস পর্বতে যজ্ঞ করেন৷ শিব মূর্তি প্রধান বৈশিষ্ঠগুলি হল তাঁর রয়েছে তৃতীয় নয়ন৷ এই তৃতীয় নয়ন যেকোনও প্রকার জিনিস ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে৷<br>

২) শিবের জন্মের পিছনেও রয়েছে একটি কাহিনী৷ কথিত আছে, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মার মধ্যে কে সবথেকে শক্তিশালি দেবতা সেই নিয়ে চলছিল বিতর্ক৷ আর সেই সময়ই সমগ্র বিশ্ব তোলপাড় করে একটি স্তম্ভ সৃষ্টি হয়৷ সেই স্তম্ভ থেকেই সৃষ্টি হয় শিব ঠাকুরের৷ আর সেই সময়ই বিশ্বজুড়ে ঝড়ের সৃষ্টি হয়৷ আর তার এই ক্ষমতা দেখেই ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুও স্বীকার করে নিয়েছেন যে তাদের থেকেও শক্তিশালি দেবতা এই শিব৷<br>

৩) হিন্দুধর্মে অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে শিব ঠাকুরই সবচেয়ে শক্তিশালি দেবতা৷ গলায় সাপ, জটায় অর্ধচন্দ্র, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, হাতে ত্রিশুল এবং হাতে ডমরু৷ তিনি একজন ঐশ্বরিক বিচারক৷ যেকোনও রকম অস কাজই তার কাছে ক্ষমার অযোগ্য৷ ধ্যানের মাধ্যমে তিনি তার শরীরে আধ্যাত্মিক শক্তির সৃষ্টি হয়৷ নটরাজ রূপে তিনি যখন নৃত্য করেন, তখন সেটির মাধ্যমে তিনি তার ভক্তদের কষ্ট দূর করেন৷

ইন্দ্র

ইন্দ্র (/ˈɪndrə/, সংস্কৃত: इन्द्र) একজন হিন্দু বৈদিকদেবতা,[১]হিন্দুপুরাণে স্বর্গের ও দেবতাদের রাজা।[২]তার রাণীর নাম শচীদেবী এবং হাতীর নাম ঐরাবত। তার বাহন পুষ্পক রথ। মূলত ইন্দ্র কোন বিশেষ দেবতা নন, যিনি স্বর্গের রাজা হন তিনিই ইন্দ্র। ইন্দ্রের বিশেষ অস্ত্র হল বজ্র বা বিদ্যু

দেবতাদের রাজা। বারাণসীতে মহাদেবের আরাধনা করে দেবরাজত্ব লাভ করেছিলেন। সুররাজ ইন্দ্র বালখিল্যগণকে উপহাস করেছিলেন বলে তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে মহাদেবের আরাধনা করেন। মহাদেব দেখা দিলে তাঁকে অনুরোধ করেন, দ্বিতীয় ইন্দ্র সৃষ্টি করার জন্য। মহাদেব বালখিল্যগণকে আস্বস্থ করেন এই বলে যে, শীঘ্র এক পক্ষীন্দ্রের (গরুড়) জন্ম হবে – যিনি ইন্দ্রকে পরাস্ত করবেন।<br>

আর্যসভ্যতার ইতিহাসবেত্তাদের মতে ইন্দ্র সম্ভবত ভারতে আগত আর্যদের মধ্যে কোন এক রাজার নাম, যা কালক্রমে দেবতাদের রাজা আখ্যান পেয়েছে হিন্দুধর্মে। তবে ঋকবেদে ইন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত অনুযায়ী ইন্দ্র অর্জুনের পিতা। পাণ্ডুপত্নী কুন্তী এক বলশালী পুত্রকামনা করে পুত্রেষ্টি মন্ত্রে ইন্দ্রকে আহ্বান করেন ও অর্জুনের জন্ম দেন।

 

 ব্রহ্মাদেব ও হরিদাস ঠাকুর

 

ব্রজলীলায় পরমেশ্বর ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ, বৃন্দাবনে গোবালক রুপে প্রতিদিন বিভিন্ন বনে গাভী বাছুরদের নিয়ে ঘাসজল খাওয়াতে কোনো সরোবরের তীরে এসে বিশ্রাম নিতেন। প্রতিদিন বনভোজন করতেন। এবং প্রায় প্রতিদিনই কংসের প্রেরিত দু-একটি অসুর নিধন করতেন।

 

যেদিন শ্রীকৃষ্ণ 'অঘাসুর'কে বধ করেন, সেদিন স্বর্গের দেবতারা স্বর্গ হতে পুস্পবৃষ্টি করতে লাগলো। তাঁরা বলাবলি করছিলো যে, "এই গোবালক  কৃষ্ণ হলো পরমেশ্বর ভগবান, স্বয়ং গোলোকপতি।

 

ব্রহ্মা  'পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণে'র  এই বালক রুপের অদ্ভুত লীলা দর্শন করে আশ্চর্য হয়ে, আরও অধিক মহিমান্ডিত কার্য উপভোগ করার জন্য সমস্ত গোবসগুলি ও গোপসখাদের মায়া দ্বারা চুরি করে আকাশের অন্য কোনো গ্রহে লুকিয়ে রাখলেন।

 

ব্রহ্মা যখন তাঁর সময়ের পরিমাণে এক নিমেষের মধ্যে সমস্ত গোপশিশু এবং গোবসদের একটা পাহাড়ের গুহায়্য রেখে ফিরে এসে দেখলেন তাদের। ঠিক আগের মতো খেলা করছে, আর তাতে  তিনি অত্যন্ত বিষ্মিত হলেন।

 

ব্রহ্মা ভাবতে লাগলেন, “আমি এদের মায়াশয্যায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। তাহলে কী করে সেই বালক ও গোবসরাই এখানে কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছে? তার মানে কী তারা আমার মায়ার দ্বারা প্ৰভাবিত হয়নি?

তারা কী গত এক বছর ধরে এভাবে কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছে?"

 

ব্ৰহ্মা বুঝতে চেষ্টা করলেন যে, তারা কে এবং কিভাবেই বা তারা তার মায়ার দ্বারা প্ৰভাবিত না হয়ে এভাবে খেলা করছে। তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, তিনি নিজেই মায়ার দ্বারা মোহিত হয়ে পড়লেন।

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই গোবস এবং গোপবালকেরা যে আসল গোবস ও গোপবালক নয়, তা ব্ৰহ্মাকে বোঝাবার জন্য শ্ৰীকৃষ্ণ তাদের বিষ্ণুমূৰ্তিতে রুপান্তরিত করলেন। প্ৰকৃতপক্ষে প্ৰকৃত গোব  এবং গোপবালকেরা ব্ৰহ্মার প্রভাবে নিদ্ৰামগ্ন ছিলো। কিন্তু ব্ৰহ্মা এখন যাদের দেখেছিলেন তারা সকলেই ছিলেন শ্ৰীকৃষ্ণ বা বিষ্ণুর প্রকাশ।  বিষ্ণু হচ্ছেন শ্ৰীকৃষ্ণের প্ৰকাশ, তাই ব্ৰহ্মার সামনে সেইসমস্ত গোপবালকেরা চতুভূজ বিষ্ণুমূৰ্তিতে প্ৰকাশিত হলেন। তাঁরা সকলেই দিব্য সৌন্দৰ্যে ভূষিত ছিলেন।

 

তাদের দৰ্শন করার পর ব্ৰহ্মা দেখলেন যে, অনেক অনেক ব্ৰহ্মা, শিব, দেব-দেবী, জীবসমূহ, এমনকি পিপীলিকার মতো ক্ষুদ্র জীব এবং অতি ক্ষুদ্ৰ তৃণ, গুল্ম, স্থাবর, জঙ্গম সবকিছুই মূৰ্ত হয়ে তাঁদের ঘিরে নৃত্য করছেন। তাদের নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে মধুর সুরে গান হচ্ছে এবং বাজনা বাজছে, যেনো তারা সকলেই সেই বিষ্ণুমূৰ্তিগণের পূজা করছিলেন। ব্ৰহ্মা বুঝতে পারলেন যে, সমস্ত গোবস এবং গোপবালকেরা কোনো যৌগিক শক্তির প্রভাবে বা অলৌকিক শক্তির প্রভাবে বিষ্ণুমূৰ্তিতে রুপান্তরিত হননি। এমনকি তারা বিষ্ণুমায়ার প্রভাবেও এই বিষ্ণুমূৰ্তিতে রুপান্তরিত হননি। তাঁরা হচ্ছেন স্বয়ংবিষ্ণু।

 

ব্ৰহ্মা যখন তাঁর সীমিত শক্তি এবং একাদশ ইন্দ্ৰিয়ের অন্তৰ্গত সীমিত চেতনা নিয়ে হতভম্বর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনিও জড়া প্ৰকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ একটি জীবমাত্র এবং তিনি ভগবানের হাতের ক্ৰীড়নক। পরমেশ্বর ভগবানের অচিন্ত্য শক্তি বুঝতে না পেরে ব্ৰহ্মা বিমোহিত হলেন।

 

ব্ৰহ্মার এ অবস্থা দেখে, তাৌর প্রতি ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের করুণা হলো। তিনি তখন সেই দৃশ্য থেকে যোগমায়ার আবরণ সরিয়ে নিলেন। ব্ৰহ্মা যখন একটু প্ৰকৃতিস্থ হলেন, তখন তাঁর মনে হলো যেনো তিনি মৃতপ্ৰায় অবস্থা থেকে পুনরুজ্জীবিত হলেন।

 

অনেক কষ্টে তাঁর চোখ খুলে ভগবানের নিত্য ধাম দৰ্শন করতে সক্ষম হলেন। তিনি দেখলেন যে, সেখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ একটি ছোট গোপশিশুরুপে তাঁর লীলাবিলাস করছেন। চতুর্তুজ ব্ৰহ্মা তখন তাঁর হংসবাহন থেকে নেমে এসে ভগবানের সামনে দন্ডব প্ৰণাম করলেন। ব্ৰহ্মার গায়ের রং সোনার মতো , তাই তাঁকে দেখে মনে হলো যেনো একটি স্বৰ্ণদণ্ড করে পায়ের কাছে পড়ে আছে।

 

ব্ৰহ্মার মাথার চারটি মুকুট ভগবানের শ্রীপাদপদ্মকে স্পর্শ করলো। তারপর আনন্দের আতিশয্যে ব্রহ্মার চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু পড়তে লাগলো এবং ব্রহ্মার অশ্রুবারি দিয়ে তিনি ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের পদযুগল ধৌত করলেন। তিনি বারবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রনতি জানিয়ে তাঁর অপুর্ব  লীলাসমূহ স্মরণ করতে লাগলেন এবং গদগদ বাক্যে তাঁর স্তুতি করতে লাগলেন এবং তারপর গোপবালক ও গোবসদের ফিরিয়ে দিলেন।

 

তারপর যখন ব্রহ্মা তাঁর কৃত অপরাধের জন্য দন্ড প্ৰাৰ্থনা করলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে নবদ্বীপ গিয়ে ''গৌরাঙ্গ'' নাম জপ করার নিৰ্দেশ দেন। তখন ব্ৰহ্মা পরমেশ্বর ভগবানকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে সশ্রদ্ধ প্ৰণতি জানালে পরমেশ্বর ভগবান স্মিতহাস্যে ইঙ্গিত করে ব্রহ্মলোক ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

 

পরবর্তীতে ব্ৰহ্মা গৌরাঙ্গ নাম জপ করতে থাকলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গৌরসুন্দর রুপে সেখানে আবির্ভূত হন। ভগবান শ্ৰীচৈতন্যদেব তাঁকে আশীৰ্বাদ দিতে চাইলে, ব্ৰহ্মা আশীর্বাদ স্বরুপ নবদ্বীপ লীলায় অংশগ্ৰহণ করতে চাইলেন।

 

তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্ৰহ্মাকে গৌরলীলায় হরিদাস রুপে জন্মগ্রহণ করার আশীৰ্বাদ প্ৰদান করলেন। যাতে ব্ৰহ্মা তাঁর উপাধি থেকে মুক্ত হয়ে দীনভাবে ভগবানের সেবায় অংশগ্ৰহণ করতে পারেন এবং কলিযুগের যুগধর্ম হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করে অন্যদের তাঁর লীলা দ্বারা শিক্ষা দিয়ে যাবেন।

ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিব - দেবী দুর্গা হইতে উৎপন্ন ???

দেবিসুক্তের ৭ম শ্লোকে বলা হইয়াছে - সর্বোপরি যে জগতের পিতা তাহাকেও আমি প্রসব করিয়াছি । পরম জ্ঞান-সমুদ্রের অভ্যন্তরে আমার জননস্থান । সর্ব ভুবনে আমি অনুপ্রবিষ্ট । ভূলোকের উর্ধে যে দ্যূলোক আছে , তাহাও স্থির আছে আমি স্পর্শ করিয়া আছি বলিয়া।

মারকন্দেয়-পুরানে প্রাধানিক রহস্য প্রকরনে উক্ত আছে - মহালক্ষী হইতে ব্রহ্মা ও শ্রী ; মহাকালি হইতে রুদ্র ও ত্রয়ী এবং মহাসরস্বতি হইতে বিষ্ণু ও গৌরী উৎপন্না হইয়াছেন। পরে মহাশক্তি ব্রহ্মাকে ত্রয়ী ; রুদ্রকে গৌরী ও বিষ্ণুকে শ্রী , পত্নী রূপে অর্পণ করিয়াছেন ।

এই সিদ্ধান্তে প্রমানিত হয় যে, ব্রহ্মা , বিষ্ণু এবং শিবও মহাশক্তি হইতে উৎপন্ন ; তাই দেবিসুক্ত বলিতেছেন , - জগতের যে পিতা তাহাকেও আমি প্রসব করিয়াছি।

মায়ের যেটি জননস্থান , মূল গৌরীপীঠ, সেটি কোথায় , - তাই বলিতেছেন, - অপ্সু অন্তঃসমুদ্রে " জ্ঞান সমুদ্রের গভীরে গূঢ়ভাবে নিহিত। উপনিষদ তাহাকে গুঢ়াত্মা বলিয়াছেন।

সেই গূঢ় বস্থুকে স্থুল বুদ্ধি দ্বারা জানা যায় না । কঠোপনিষদের মন্ত্রে আছে -

দৃশ্যতে অগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদশিভিঃ ।। " (৩/১২)

= সূক্ষ্ম দর্শী অতি তীক্ষ্ম বুদ্ধির সাহায্যে তাহাকে জানিতে পারেন। সেই গূঢ়যোনিস্থান হইতে অনন্ত বিশ্ব উদ্ভুত । মা যে কেবল প্রসব করিয়াছেন তাহা নহে, প্রসূত সকল বস্থুতে তিনি প্রবেশ করিয়াছেন। শ্রুতি মন্ত্রে আছে -

তৎ সৃষ্টা তদেবানুপ্রাবিশৎ "

ভূলোক হইল স্থূল জগত, দ্যুলোক হইল সূক্ষ্ম জগত; এই দুই স্থিত আছে কারন রূপিণী মহাশক্তি তাহার দেহ দ্বারা স্পর্শ করিয়া আছেন বলিয়া। তিনি ছুইয়া আছেন বলিয়াই নিখিল বিশ্ব ক্রিয়াশিল।

দেবিসুক্তের এই সপ্তম মন্ত্রে বলা হইল যে, মহাশক্তি সকল কারনের কারন স্বরুপিনি। তাহার কৃপা স্পর্শে নিখিল বিশ্ব জীবন্ত । মাতৃ অঙ্কে জগৎ সংসার বিধৃত। ( Dr. mohanambroto brommocari )

 

 

ব্রহ্মা কর্তৃক ত্রিগুণ বর্ণনা

 

প্রজাপতি ব্রহ্মা একদা সাধনরত ঋষিগণের সকাশে প্রকটিত হয়ে, সেই ঋষিগণকে বললেন, "মহর্ষিগণ! এবার আমি তোমাদের রজোগুণের স্বরূপ এবং কার্যের গুণাদির যথাযথ বর্ণনা করবো। মন দিয়ে শোনো-- সন্তাপ, রূপ, আরাম, সুখ-দুঃখ, শীত-গ্রীষ্ম, ঐশ্বর্য, বিগ্রহ, সন্ধি, হেতুবাদ, মন অপ্রসন্ন থাকা, বল, শৌর্য, অহংকার রোষ ব্যায়ম, বিবাদ, ঈর্ষা, ইচ্ছা, পরচর্চা, যুদ্ধ করা, মমত্ব বোধ, কুটুম্ব পালন, বধ, বন্ধন, ক্লেশ, ক্রয়-বিক্রয়, অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা, উগ্রতা, নিষ্ঠুরতা, চিৎকার, অন্যের দোষ দেখা, লৌকিক বিষয় চিন্তা করা, অনুতাপ, অসত্যভাষণ, মিথ্যা দান, সংশয়পূর্ণ বিচার, তিরস্কার, নিন্দা, স্তুতি, প্রশংসা, প্রতাপ, জোর খাটানো, স্বার্থের জন্য কাজ, তৃষ্ণা, অপরের আশ্রয়ে থাকা, ব্যবহার কুশলতা, নীতি, প্রমাদ, পরিবার এবং পরিগ্রহ - এ গুলি সবই রজোগুণের কার্য।

.

জগতে যে নারী, পুরুষ, ভূত, দ্রব্য এবং গৃহাদির পৃথক পৃথক সংস্কার, অবিশ্বাস, সকামভাবে ব্রত-নিয়মাদি পালন, কাম্যকর্ম, নানা প্রকারের জলাশয় খনন, স্বাহাকার, নমস্কার, স্বধাকার, বষট্কার, যাজন, অধ্যাপন, যজন, অধ্যায়ন, দান, প্রতিগ্রহ, প্রায়শ্চিত এবং মঙ্গলজনক কর্মকেও রাজস বলে মনে করা হয়।

.

"আমার বস্তু প্রাপ্তি হোক, অমুক জিনিস লাভ হোক"- এই প্রকার যার বিষয়াদি পাওয়ার জন্য আসক্তি মূলক উৎকন্ঠা হয়, রজোগুণই তার কারণ।

.

দ্রোণ, মায়া, শঠতা, মান, চুরি, হিংসা, ঘৃণা, পরিতাপ, জাগরণ, দম্ভ, দর্প, রাগ, বিষয়প্রেম প্রমোদ, দ্যূতক্রীড়া, ঝগড়া-বিবাদ করা, নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি, গান-বাজনা, নৃত্য-গীতে আসক্ত হওয়া- এ গুলি সবই রাজস গুণ।

.

যারা এই পৃথিবীতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পদার্থের কথা চিন্তা করে, ধর্ম, অর্থ ও কামরূপ ত্রিবর্গের সেবায় ব্যাপৃত থাকে, ইচ্ছমতো আচরণ করে এবং সর্বপ্রকার ভোগের সমৃদ্ধিতে আনন্দিত থাকে, তারা রজোগুণে আবৃত, তাদের অর্বাক্ স্রোতা বলা হয়।

.

এ রূপ লোক ইহলোকে বারংবার জন্ম নিয়ে বিষয় জনিত আনন্দে মগ্ন থাকে এবং ইহলোকে ও পরলোকে সুখ লাভের জন্য চেষ্টা করে। মুনিবরগণ! আমি তোমাদের নানা প্রকার রাজসিক গুণ এবং তদনুকূল আচরণের যথাবৎ বর্ণনা করলাম। যেসব মানুষ এই গুণগুলিকে জানে, তারা সর্বদা এর বন্ধন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।

.

মহর্ষিগণ! এবার আমি তৃতীয় উত্তমগুণ অর্থাৎ সত্ত্বগুণের বর্ণনা করছি, এই গুণ জগতের সমস্ত প্রাণীদের হিতকারী এবং সাধুপুরুষদের প্রশংসনীয় ধর্ম। আনন্দ, প্রসন্নতা, উন্নতি, প্রকাশ, সুখ, কৃপণতার অভাব নির্ভয়তা সন্তোষ, শ্রদ্ধা, ক্ষমা, ধৈর্য, অহিংসা, সমতা, সত্য সারল্য, ক্রোধহীনতা, অন্যের দোষ না দেখ , পবিত্রতা, চতুরতা ও পরাক্রম-- এ গুলি সত্ত্বগুণের কার্য।

.

যারা এই ধর্মের আচরণ করে, তারা পরলোকে সুখভাগী হয়। মমত্ববোধ, অহংকার, আশা পরিত্যাগ করে সর্বত্র সমদৃষ্টি রাখা এবং সর্বতোভাবে নিষ্কাম হওয়াই সাধু পুরুষদের সনাতন ধর্ম।

.

বিশ্বাস, লজ্জা, তিতিক্ষা, ত্যাগ, পবিত্রতা, আলস্যবর্জন করা, কোমলতা, মোহগ্রস্থ না হওয়া, প্রাণীদের সঙ্গে সৎ ব্যবহার, পরচর্চা না করা, হর্ষ, সন্তোষ, বিস্ময়, বিনয়, সত্যব্যবহার, শান্তিকর্মে শুদ্ধভাবে প্রবৃত্ত হওয়া, উত্তম বুদ্ধি, আসক্তি মুক্ত হওয়া, জগতের ভোগে উদাসীনতা, ব্রহ্মচর্য, সর্বপ্রকার ত্যাগ, নির্মমতা, ফলের কামনা না করা, নিরন্তর ধর্ম পালন করতে থাকা-- এ সবই সত্ত্বগুণের কার্য।

.

যারা উপরিউক্ত আচরণ পালন পূর্বক এই জগতে সত্যের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং বেদেরখউৎপত্তির স্থানভূত পরব্রহ্ম পরমাত্মাতে নিষ্ঠা রাখে, তাদেরই ধীর এবং সাধুদর্শী বলে মানা হয়। এই ধীর পুরুষেরা সব পাপ পরিত্যাগ করে শোকরহিত হন এবং স্বর্গলোকে গিয়ে অনেক শরীর সৃষ্টি করেন। সত্ত্বগুণ ভাবাপন্ন মহাত্মা স্বর্গবাসী দেবতাদের ন্যায় ঈশিত্ব, বশিত্ব এবং লঘিমা ইত্যাদি সিদ্ধি প্রাপ্ত করেন।

.

তাঁদের ঊর্ধ্বস্রোতা এবং বৈকারিক দেবতা বলে মানা হয়। যোগবলে স্বর্গলাভ হলে, তাঁদের চিত্ত ভোগজনিত সংস্কার দ্বারা বিকৃত হয়। সেই সময় তাঁরা যা চান, সেই বস্তুই পান এবং দান করেন। আমি তোমাদের সত্ত্বগুণের কার্যাদি বর্ণনা করলাম। যারা এই বিষয়ে ভালো ভাবে জানে, তারা মনোবাঞ্ছিত বস্তু লাভ করে এবং সেই গুণের সেবনে রত থাকলে তাদের আর বন্ধন প্রাপ্তি হয় না।"

.

ব্রহ্মা বললেন, "মহর্ষিগণ! তিন প্রকার গুণ যখন সাম্যাবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন তাকে বলা হয় অব্যক্ত প্রকৃতি। অব্যক্ত সবই প্রাকৃত কার্যে ব্যাপক, অবিনাশী এবং স্থির স্বভাব বিশিষ্ট। উপরিউক্ত তিন গুণে যখন বৈষম্য আসে তখন সেটি পঞ্চভূতের রূপ ধারণ করে এবং তার থেকে নবদ্বার সম্পন্ন নগর যা শরীর উৎপন্ন হয়। এই নগরে জীবাত্মাকে বিষয়াদির দিকে প্রেরিতকারী একাদশ ইন্দ্রিয় থাকে। মনের দ্বারা তার অভিব্যক্তি হয়।

.

বুদ্ধি এই নগরের প্রভু। এতে যে তিনটি স্রোত চিত্তরূপ নদীর প্রবাহ, তা সর্বদা পূর্ণ থাকে। এ গুলি পূর্ণ করার জন্য তিনটি গুণময় নাড়ি আছে। তাদের সত্ত্ব, রজ ও তম বলা হয়। এরা পরস্পর একে অন্যের আশ্রিত এবং একে অপরের সাহায্যে টিকে থাকে। যেখানে তমোগুণ বাধা পায় সেখানে রজোগুণ বৃদ্ধি পায়, যেখানে রজোগুণকে দমন করা হয় সেখানে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিলাভ করে। তমকে অন্ধকাররূপ বলে জানতে হবে। এর অপর নাম মোহ। এটি অধর্মের দিকে প্রেরণ করে এবং অন্যায় ও পাপকারীদের মধ্যে নিশ্চিত রূপে বিদ্যমান থাকে। তমোগুণের এই স্বরূপ অন্যান্য গুণের সঙ্গেও মিশ্রিত দেখা যায়।

.

রজোগুণ হলো প্রকৃতি রূপ। এটি সৃষ্টির উৎপত্তির কারণ। সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই এই প্রবৃত্তি দেখা যায়। এর দ্বারাই দৃশ্য জগতের উৎপত্তি হয়েছে। সর্ব প্রাণীতে স্থিত প্রকাশ অহংকার শূন্যতা এবং শ্রদ্ধা, এগুলি সত্ত্বগুণের স্বরূপ। সাধু ব্যক্তিরা নিরহংকারের প্রশংসা করেছেন।

.

এবার আমি যুক্তিপূর্বক, যথোপযুক্তভাবে এই তিন গুণাদির কার্যের যথার্থ বর্ণনা করছি। মন দিয়ে শোনো। মোহ, অজ্ঞান, ত্যাগহীনতা, কর্মাদির সম্বন্ধে নির্ণয় করতে না পারা, নিদ্রা, অহংকার, ভয়, লোভ, শোক, শুভ কর্মে দোষ দেখা, স্মরণ-শক্তির অভাব, পরিণাম চিন্তা না করা, নাস্তিকতা, দুশ্চারিত্রা, নির্বিশেষতা বা ভালো-মন্দ বিবেচনার অভাব, ইন্দ্রিয়ের শৈথিলা, হিংসাদি নিন্দনীয় দোষে প্রবৃত্ত হওয়া, অকার্যকে কার্য এবং অজ্ঞানকে জ্ঞান বলে মনে করা, শত্রুতা, কাজে মন না দেওয়া, অশ্রদ্ধা, মূর্খের মতো চিন্তা, কুটিলতা, কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা না থাকা, পাপ করা, অজ্ঞান, আলস্য ইত্যাদির জন্য দেহের জড়তা, ভাব-ভক্তি না থাকা, অজিতেন্দ্রিয়তা এবং নীচ কর্মে আসক্তি, এই সবই হলো তমোগুণের কাজ।

.

এতদ্বাতীত আরও যেসব বিষয় ইহলোকে নিষিদ্ধ বলা হয়, সেগুলিও তমোগুণের কার্য বলে জানবে। দেবতা, ব্রাহ্মণ ও বেদের নিন্দা করা, দান না করা, অভিমান, মোহ, ক্রোধ, অসহশীলতা এবং মাৎসর্য, এ সবই তামস আচরণ। যা বিধি এবং শ্রদ্ধারহিত বৃথা কার্য শুরু করা, দেশ-কাল-পাত্র বিচার না করে অশ্রদ্ধা এবং অবহেলা পূর্বক দান করা, দেবতা ও অতিথিদের না দিয়ে আহার করাও তামসিক কার্য। অতিবাদ, অক্ষমা, মাৎসর্য, অভিমান এবং অশ্রদ্ধাকে তমোগুণের ফল বলে মানা হয়। এ জগতে এইরূপ আচরণ বিশিষ্ট এবং ধর্ম মর্যাদা ভঙ্গকারী যেসব পাপী ব্যক্তি আছে, তাদের সকলকেই তমোগুণী বলা হয়। এরূপ পাপী মানুষদের পরবর্তী জন্মে যে যোনিতে যাওয়া অনিবার্য তার পরিচয় জানাচ্ছি।

.

এদের মধ্যে অনেকে নরকগামী হয়, আর কিছু তির্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। স্থাবর বা বৃক্ষ-পর্বত ইত্যাদি, পশু, মালবাহী জীব, রাক্ষস, সর্প, কীট-পতঙ্গ, পক্ষী, অণ্ডজ প্রাণী, চতুষ্পদ প্রাণী, মানসিক ভারসাম্যহীন, কালা-বোবা ইত্যাদি ও অনন্যা যতো পাপময় রোগযুক্ত যা কুষ্ঠ ইত্যাদি মানুষ, তারা সকলেই তমোগুণে আচ্ছন্ন রয়েছে। নিজ কর্মানুসারে উপযুক্ত এইসব দুরাচারী জীব সর্বদা দুঃখে নিমজ্জিত থাকে। তাদের চিত্তবৃত্তির প্রবাহ নিম্নগামী। তাই তাদের অর্বাক স্রোতা বলা হয়। এরা সকলেই তমোগুণী। তম (অবিদ্যা), মোহ (অস্মিতা) , মহামোহ (রাগ, আসক্তি), ক্রোধ নামযুক্ত তামিস্র এবং মৃত্যুরূপ অন্ধতামিস্র, এই পাঁচ প্রকারের তামসী প্রকৃতি বলা হয়।

.

বিপ্রবরগণ! বর্ণ, গুণ, যোনি এবং তত্ত্ব অনুসারে আমি তমোগুণের সম্পূর্ণ বর্ণনা করলাম। যাদের দৃষ্টি অসার তত্ত্বে নিবদ্ধ থাকে, এমন কোন ব্যক্তি এই বিষয়কে ভালোভাবে বুঝতে পারবে? এই বিপরীত দৃষ্টিই তমো গুণের পরিচয়। তমোগুণের স্বরূপ ও তার কার্যাদির নানা প্রকার গুণের যথাবৎ বর্ণনা করা হলো। যে ব্যক্তি এই গুণগুলি ঠিকভাবে জানে, সে তামসিক গুণ থেকে সর্বদা মুক্ত থাকে।"

 

অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ড

 

পরমেশ্বর ভগবানের সৃষ্ট অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আমরা এই ক্ষুদ্রতম গ্রহনক্ষত্রাদি বেষ্টিত একটা ব্রহ্মান্ডের জীব। কিন্তু আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, এই ব্রহ্মান্ডই ভগবদ্ সেবার উপযোগী। এ প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের একটা আখ্যান আমাদের ভক্ত বন্ধুদের কাছে শোনানোর চেষ্টা করছি।

 

একবার এই ব্ৰহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকৰ্তা চতুর্মুখ ব্ৰহ্মা, দ্বারকায় এসেছেন দ্বারকাধীশ ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ লাভের জন্য। দ্বারপাল যখন ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণকে ব্ৰহ্মার আগমনের কথা জানালেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “কোন ব্ৰহ্মা সাক্ষাৎ প্ৰাৰ্থী?"

 তখন দ্বাররক্ষী ব্ৰহ্মাকে সেই কথা জিজ্ঞাসা করলেন, ''আপনি কোন ব্রহ্মা?''

 ব্ৰহ্মাজী বিস্ময়ান্বিত হলেন এবং ভাবলেন, 'আমি ছাড়া আবার দ্বিতীয় কোনও ব্ৰহ্মা আছে নাকি?'

 অগ্যতা ব্ৰহ্মা দ্বারপালকে বললেন, “বলুন, চতুঃসনের পিতা চতুর্মুখ ব্ৰহ্মা সাক্ষাৎ প্ৰাৰ্থী।"

 দ্বারপালের নিকট সেই কথা শুনে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্ৰহ্মাকে ভিতরে আসতে বললেন। চতুর্মুখ ব্ৰহ্মা প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্ৰণাম নিবেদন করলেন। তারপর কৌতুহল নিবারণের জন্য ব্ৰহ্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ''হে ভগবান! আমার একটি সংশয় নিবারণ করুন। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্ৰহ্মা আছে নাকি?"

 সেই মুহূর্তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে অনন্ত কোটি ব্ৰহ্মাণ্ডের ব্ৰহ্মারা একে একে আসতে শুরু করলেন। কারও দশটি মুখ, কারও একশো এক, দশ হাজার, কারও এক লক্ষ, আবার কারও দশ লক্ষটি মুখ।

 যখন সকল ব্ৰহ্মারা একযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্ৰণাম করছিলেন, তখন ঝনঝন করে প্রচণ্ড আকারে মাথার শিরস্ত্রানের আওয়াজের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো। তাঁদের সম্মুখে চতুর্মুখ ব্ৰহ্মাকে একটি ছোট্ট ইদুরের মতো মনে হছিলো।

 শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় দিব্যচক্ষু লাভ করে ব্ৰহ্মা তা দেখতে পাছিলেন। সকল ব্ৰহ্মারা যখন অদৃশ্য হয়ে গেলেন, তখন অনন্ত কোটি ব্ৰহ্মাণ্ডের ইন্দ্ৰৱা একে একে আসতে আরম্ভ করলেন। তখন চতুর্মুখ ব্ৰহ্মার সংশয় একেবারে দূরীভূত হলো।

 এমতাবস্থায় ব্ৰহ্মা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন যে, এই ব্ৰহ্মাণ্ডটি অনন্ত কোটি ব্ৰহ্মাণ্ডের তুলনায় সবচেয়ে ক্ষুদ্ৰতম এবং তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে ক্ষুদ্ৰতম ব্ৰহ্মা।

 চতুর্মুখ ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, "প্রভু, আমার ব্রহ্মান্ডের বিশেষত্ব কি?"

 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "দেখো, তোমার ব্রহ্মান্ডের জীবের আয়ু বড়োই স্বল্প। তবুও এই ব্রহ্মান্ড আমার সাধন ভজন করার উপযুক্ত স্থান। এখানে আমি ভক্তদের হৃদয়ের ভক্তি পাওয়ার আশায় সদা উদগ্রীব থাকি। আর তারা ভক্তির সাথে, আমার সাধন ভজন করে, সহজেই আমার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে।"

 আর আমরা, চতুর্মুখ ব্রহ্মার এই ব্রহ্মান্ডের জীবেরা হচ্ছি, এই ক্ষুদ্রতম ব্রহ্মার সৃষ্ট অসংখ্য কোটি ক্ষুদ্রতম অনুজীবের এক নুন্যতম কণাজীব। অথচ কতো গর্ব করি আমরা। আমরা বার বার আত্মগর্বে ভুলে যাই আমাদের করণীয় সম্পর্কে।

 

 ব্রহ্মান্ডের বিস্তার

 

ব্রহ্মান্ডের আকৃতি অনেকটা অন্ডের মতো এবং প্রতিটি গ্রহেই ভগবান একজন করে আলদা আলাদা ক্ষকতাধারী ব্রহ্মাকে নিযুক্ত করে রেখেছেন অধিপতি হিসাবে। আর এথেকেই নাম হয়েছে-ব্রহ্মা+অন্ড=ব্রহ্মান্ড।

         এই ব্রহ্মান্ড চৌদ্দটি ভূবন নিয়ে গঠিত

 আমরা যে ভূপৃষ্ঠে রয়েছি এটি ভূর্লোক। এর উপরদিকে ৬ টি লোক এবং নীচের দিকে ৭টি লোক নিয়ে ১৪টি লোকের বিস্তার।

 

ভূর্লোকের ১২০০ কিমি উপরে অবস্থিত ভূবর্লোক,যেখানে যক্ষ,রাক্ষস,ভূত ইত্যাদির অবস্থান। এরও ১২০০ কিমি উপরে অবস্থিত স্বর্গলোক-দেবতাদের স্থান।

এর উপরে মহর্লোক-ভৃগুমুনি জাতীয় মুনিদের আবাস।

ভূর্লোক থেকে ১২ কোটি কিমি উচ্চতায় অবস্থিত জনলোক-চতষ্কুমারের অবস্থান।

৯৬ কোটি কিমি উচ্চতায় তপোলোক-স্বর্গের যে সমস্ত দেবতারা সাধনায় উচ্চতা লাভ করে,সেইসব দেবতাদের লোক।

৪৮০ কোটি কিমি দূরে অবস্থিত সত্যলোক-ব্রহ্মার আবাস। এতদূর পর্যন্ত ব্রহ্মান্ড। ব্রহ্মাও আমাদের মতো জীব,তারও প্রলয়কালে মৃত্যু হয়। সত্যলোকের উত্তরদিকে ধ্রুবলোক অবস্থিত,যা আমরা ধ্রুবতারারূপে দেখি।

 

এবার আসি নীচের দিকে-

এক্ষেত্রে প্রত্যেক লোকের মাঝের দূরত্ব ১ লক্ষ ২০ হাজার মাইল। ভূর্লোকের নীচে অতল-যেখানে ময়দানবের পুত্র বল থাকে

এর নীচে বিতল-হরগৌরীর লোক-যেখানে হাটক নামক সোনা উৎপন্ন হয়।

এর নীচে সুতল-এখানে বলি মহারাজ থাকে,যার কাছে বামন অবতারে সবকিছু নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই কল্পের শেষে দেবরাজ ইন্দ্রকে সেখানে পাঠানো হবে,এবং বলি মহারাজকে স্বর্গের রাজা করা হবে।

এর নীচে তলাতল-এখানে ময়দানব,যিনি পান্ডবদের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থে রাজপুরী নির্মাণ করেছিলেন।

এর নীচে মহাতল-দৈত্য-দানবরা থাকে।

রসাতল-জ্যোতির্ময় মনিসম্পন্ন সর্পদের আবাস। এ থেকেই কেউ অধঃপতনে গেলে বলা হয়-রসাতলে গেছে।

এরপর পাতাল-বাসুকীনাগ এর অবস্থান,যিনি সমুদ্রমন্থনে রজ্জু হয়েছিলেন।

পাতালের দক্ষিণদকে নরক অবস্থিত।

 

ব্রহ্মান্ডের সম্পূর্ণ বিস্তার দিলাম। পরের পোস্টে চিদাকাশ এবং ব্রহ্মান্ডের বাইরের লোকগুলি বলব। তবে জানি,কিছু শুদ্ধ নাস্তিক প্রকৃতির লোক আসবে এই পোস্টটির বিরোধীতা করতে। যাদের স্বভাবই সঠিক শিখব না,আর না জেনেই বিরোধীতা করব। আমি দেখি অনেককে-অনেক প্রচারক শাস্ত্রের সত্য কথা লেখে,আর কিছু অপদার্থ,জ্ঞানহীন আজেবাজে কমেন্ট করে।

         এসব তারাই করে-যারা কখনোই শাস্ত্রের ধারেকাছে ঘেঁষে না।এরা স্বর্গের অস্তিত্ব মানে,কিন্তু নরকের ক্ষেত্রে বলে-নরক বলে কিছু নেই। তাই তো এই মূর্খের দল আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে,কত সহজে বলে উনি নাকি স্বর্গবাসী হয়েছেন।

মহাশয়,শ্রাদ্ধে আমিষ ভক্ষণ করিয়ে,কোন মৃত আত্মা স্বর্গবাসী হতে পারে না।

তাই ধর্মীয় আইডির রিপোর্ট করে,নিজের পাপ আরও বাড়ে। অবিশ্বাস্য মনে হলে দূরে সরে যাবেন।

সঠিক জানতে সাহায্য করছি,,জানুন!!

 

আমাদের ব্রহ্মান্ডের অন্তর্ভুক্ত গ্রহলোক সমুহঃ

.    ব্রহ্মলোকঃ            ব্রহ্মাজির নিবাস

.     তপোলোকঃ           ব্রহ্মার চার পুত্র, সনক, সনাতন, সনন্দন এবং সনকুমারদের নিবাস

.    জনলোকঃ            নব যোগেন্দ্র ঋষিদের নিবাস

.     মহর্লোকঃ            ভৃগুমণি ও অন্যান্য ঋষিদের নিবাস

.    স্বর্গলোকঃ            দেবতাদের নিবাস

.    ভুবর্লোকঃ            পিতৃপুরুষদের নিবাস

.     ভুবলোকঃ                  মনুষ্য, পশু পাখি ও অন্যান্য জীবদের নিবাস

.    অতলঃ              দানবদের নিবাস

.    বিতলঃ              হাটকেশ্বর শিবের নিবাস       

১০.   সুতলঃ              বামন অবতার দ্বারা রক্ষিত বলী মহারাজের নিবাস

১১.   তলাতলঃ            শিব দ্বারা রক্ষিত ময় দানবদের নিবাস

১২.    মহাতলঃ             কালীয় নাগ এবং দিতি পুত্র দৈত্যদের নিবাস

১৩.   রসাতলঃ             অসুরদের নিবাস

১৪.    পাতালঃ                   বাসুকি নাগের নিবাস

 

বি:দ্র: এরকম ছোট বড় অনন্ত কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে এই জড় জগতে এই জড় জগতের উর্ধ্বে হচ্ছে চিন্ময় জগত অর্থা ভগবধাম এই ভগব ধামই হচ্ছে সকল জীবের পরমাগতির স্থান

 

ব্রহ্মাণ্ড এর হিসেব - নিকেশ :-

মহা আকাশে অসংখ্য অগণিত ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে। আমরা একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ডের ভিতরে রয়েছি। কোন কোন ব্রহ্মান্ডের বিস্তার শতকোটি যোজন, কোন্ওটি নিখর্ব বা ‘দশ সহস্র কোটি’ যোজন, কোনওটি পদ্মাযুত বা ‘দশ লক্ষ কোটি অযুত’ যোজন।

সূর্য থেকে ব্রহ্মাণ্ডের গোলকের মধ্যবর্তী দূরত্ব ৩০০ কোটি কিলোমিটার এই হিসাব অনুসারে, ব্রহ্মাণ্ডের গোলকের অন্তবর্তী এক প্রান্ত থেকে বিপরীত প্রান্তের দূরত্ব ৬০০ কোটি কিলোমিটার। এইভাবে আমাদের ছোট ব্রহ্মাণ্ডটির আভ্যন্তরীণ বিস্তার বা পরিধি হচ্ছে ১৩,৬২০ কোটি কিলোমিটার। ব্রহ্মাণ্ডের পুরু আবরণীগুলোকে যুক্ত করলে ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তার-পরিমাণ অনেকগুণ বাড়বে।

মহাকাশের ব্রহ্মাণ্ড সমূহের ভেতরে কতকগুলি ভুবন আছে। কোন ব্রহ্মাণ্ডে লক্ষ ভুবন, কোন ব্রহ্মাণ্ডে অজুত ভুবন, কোন ব্রহ্মাণ্ডে সহস্র ভুবন, কোনটিতে শতভুবন, কোনওটাতে সত্তর, কোনওটাতে পঞ্চাশ কোনওটাতে কুড়িটি ভুবন আছে। আমাদের ছোট্ট ব্রহ্মাণ্ডে চৌদ্দটি ভুবন রয়েছে। সেগুলি হল- ১) ভূলোক, ২) ভুবর্লোক. ৩) স্বর্গলোক, ৪) মহর্লোক, ৫) জনলোক, ৬) তপোলোক, ৭) সত্যলোক, ৮) অতল, ৯) বিতল, ১০) সুতল, ১১) তলাতল, ১২) মহাতল, ১৩) রসাতল, ১৪) পাতাললোক। সত্যলোকের উত্তরে ধ্রুবলোক এবং পাতাললোকের দক্ষিণে নরকলোক বিদ্যমান। অবশ্য বিশাল ধ্রুবলোক ব্রহ্মার শাসনাধীন নয়।

 

ব্রহ্মার আবাস সত্যলোক। ব্রহ্মার বহু মাথা, বহু বাহু। কোন কোনও ব্রহ্মাণ্ডের কোটি মুখ, কোনও ব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ মুখ, কোনও ব্রহ্মাণ্ডের সহস্র মুখ, কোথাও বা শত মুখ, কোথাও চৌষট্টি মুখ, কোথাও অষ্টমুখ মুখ। আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডের ব্রহ্মা হচ্ছেন চতুর্মুখ অর্থ্যাৎ চার মাথা।

সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডগুলিতে বিভিন্ন দেশ বা ভুবন বিভাগ রয়েছে, প্রায়ই ব্রহ্মাণ্ডগুলির জীবও সমতুল্য, তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি প্রায় সমতুল্য। ৮৪ লক্ষ রকমের জীব প্রজাতি প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডেই আছে বলা যায়।

শ্রীকূর্মপুরাণে বলা হয়েছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি কখনও কখনও সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে একই সঙ্গে সংহার করে থাকেন। বিষ্ণুধর্মোত্তরে বলা হয়েছে যে, জগৎপতি শ্রীহরি যখন সেই সমস্ত অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের এক কালে সংহার করে আত্মারামভাবে অবস্থান করেন সেই সময়টি তাঁর রাত্রি বলে কীর্তিত হয়। পুনরায় যখন শ্রীহরি ব্রহ্মাণ্ডগুলি সৃষ্টি করেন তখন কখনও ভিন্ন আকারে, কখনও বা একরূপ আকারে সৃষ্টি করে থাকেন, সেটি ভগবানের দিন।

চিন্ময়-জগৎ ভগবানের অঙ্গজ্যোতিতে আলোকিত থাকে। কিন্তু অভ্যন্তরে অন্ধকার। সূর্য ইত্যাদি জ্যোতিষ্ক গ্রহ দ্বারা ব্রহ্মাণ্ড আলোকিত।

 

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ভগবানের আদেশে আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডে কত ধরনের এবং কত প্রকৃতির জীব সৃষ্টি করলেন?

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডে ভগবানের আদেশে দুই ধরনের জীব সৃষ্টি করলেন..........

1. স্থাববঃ-যারা চলাফেরা করতে পারে না একস্থানেই থাকে।

২. জঙ্গমঃ- যারা স্থান থেকে স্থানান্তরে চলাফেরা করতে পারে।    স্থাবর ও অস্থাবর জীবের

মধ্যে আবার মোট 84 লক্ষ প্রজাতির জীব সৃষ্টি করলেন।

নিম্নে প্রজাতিগুলো দেওয়া হলো.......

1)জলজ জীব 9 লক্ষ রকম।

২)গাছপালা ২0 লক্ষ রকম।

3)কীটপতঙ্গ 11 লক্ষ রকম।

4)পাখী 10 লক্ষ রকম।

5)পশু 30 লক্ষ রকম।

6)মানুষ 4 লক্ষ রকম।

 মোট = 84 লক্ষ রকম।

জীব 84 লক্ষ বার জন্ম-মৃত্যুর পরে এসে মানব

কুলে জন্ম পায়।চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ সম্পর্ককে পুরাণাদি শাস্ত্রে যা আছে তার বিবরণঃ

30 লক্ষ বার বৃক্ষ যোনিতে জন্ম হয়।এটাতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। রুদ্রের তাপ লাগে, ঝড় বৃষ্টির ফলে ডালপালা ভাঙ্গে।শীতকালে সব পাতা ঝড়ে  যায়, কুঠার দিয়ে কাটা হয়। আরো অনেক প্রকার কষ্ট পায়।তারপর জলচর রুপে জন্ম হয়। এই রুপে 9 লক্ষবার জন্ম হয়। হাত নেই, পা নেই শুধু দেহ আর মাথা। খায় পচা মাংস আর যা পায়। একজনের মাংস আরেকজন খেয়ে জীবন রক্ষা করে।

তারপর ক্রিমি যোনি 10 লক্ষ বার জন্মে। 1 লক্ষবার পাখি রূপে, তাদের ঘর বাড়ি নেই,গাছে গাছে থাকে। জোক, পোকা, পচা গলা যা পায় তাই খায়। নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, যখন সন্তান উড়তে পারে তখন আর ফিরেও তাকায় না। যদি কাক আর শকুনি হয়ে জন্মায় তবে অনেকদিন বেচে থাকে। ২0 লক্ষবার পশু যোনি, পশু নানা কষ্ট পায়। কোনো পশু হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত, কেউ বা লোকালয়ে লুকিয়ে থাকে, কেউ একে অন্যকে মেরে খায়,কেউবা ঘাস তৃণ খায়, হাল চাষায়য়, গাড়ি টানায়. যত রোগশোক হয় দিনরাত মল মুত্রের সাথেই বাস করতে হয়,গো-যোনিতে জন্ম লাভ পশুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ গো-র শেষ আর পশু জন্ম নেই। তারপর মানব কুলে  জন্ম 4 লক্ষ বার। বনের মানুষ বনের মধ্যে তারা পশুসম খাবার খায় তাদের আত্ম-পর জ্ঞান নেই। তারপর পাহাড়িয়া জাতির জন্ম হয়,নাগা, কুকি, সাওতালি ইত্যাদি। তারপর জন্ম হয় অধম কুলে,তারা দেব ধর্ম মানে না। অপকর্ম করে, মদ্য পান করে।

তারপর শুদ্রুকুলে জন্ম। যা কর্ম করে তা নিজেই ভোগ করে।কেউ অন্ধ, কেউ কানে শুনেনা ইত্যাদি হয়। কারো স্বভাব ভাল হয় কর্মগুণে, তারপর জন্মায় বৈশ্য জাতি কুলে, কর্ম অনুযায়ি ফল ভোগ করে  তারপর ক্ষত্রিয়। কর্ম ফল ভোগ হয়, অবশেষে ব্রাহ্মণকুলে জন্মায়। তারপর আর একাধিকবার জন্ম হয়না, উত্তম ব্রাহ্মণ জন্ম শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মজ্ঞান থাকলেই সে ব্রাহ্মণ, নিজের উদ্ধারে সে আত্মজ্ঞান লাভ করে। শুধু ব্রাহ্মণ কুলে জন্মালেই উদ্ধার হওয়া যায়না, যদি সে জ্ঞান লাভ করতে না পারে তবে পুনরায় সে 84 লক্ষ যোনি  ঘুরে,বারবার জন্মলাভে কষ্ট পায়,আর কোনো উপায় নেই যদি না ভগবানের শরণাগত হয়। তাই সারাদিনে অন্তত একবারের জন্য হলেও ভগবানকে ডাকুন।

 

এই ব্রহ্মান্ডের প্রথম পুরুষ নারী

এই ব্রহ্মান্ডের প্রথম পুরুষ হলেন মনু ও প্রথম নারী হলেন স্বতরুপা। মনুকে বলা হয় স্বায়ম্ভুব মনু এবং তাঁর স্ত্রী হলেন স্বতরুপা (এই ব্রহ্মান্ডের প্রথম নারী ও পুরুষ)।

 

মনু সংহিতা – মনু পুরাণ অনুযায়ী মনু ব্রহ্মার দেহ হতে উদ্ভুত, তাই তার নাম স্বায়ম্ভুব মনু। তার স্ত্রী শতরূপা, পুত্র প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ, কন্যা আকুতি, দেবাহুতি ও প্রসুতি। এর পুত্র কন্যা হতে মনুষ্য জাতির বিস্তার, তাই তারা মানব।

 

মন্বন্তর ও কল্প : সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি- এই চারটি সহস্র যুগে (অর্থা চার হাজার যুগে) ভগবান ব্রহ্মার এক দিন। ঐ এক ব্রহ্মা দিবসে চৌদ্দ জন মনু জন্মগ্রহন করেন। ঐ এক এক মনুর কাল কে বলা হয় ‘মন্বন্তর’। প্রত্যেক মন্বন্তরে ভিন্ন ভিন্ন মনু, সপ্তর্ষিগন, দেব-দেবী, ইন্দ্র ও মনুপুত্ররা আবির্ভূত হয়| দেবতাদের হিসেবে আট লক্ষ বাহান্ন বছর এবং মানুষের হিসেবে ত্রিশ কোটি সাতষট্টি লাখ বিশ হাজার বছরে এক মন্বন্তর হয়। মন্বন্তরের কাল পূর্ণ হলেই দেবতা, সপ্তর্ষি, ইন্দ্র, মনু- পুত্ররা বিলুপ্ত হয় এবং অন্য মনু, দেবতা ইত্যাদি উদ্ভব হয়। সকল মন্বন্তরেই সপ্তর্ষিরা ধর্মের ব্যবস্থা ও রক্ষার জন্য পৃথিবীতে আসেন। প্রত্তেক চতুর্যুগের শেষে বেদ বিপ্লব হয় এবং সপ্তর্ষিরা পৃথিবীতে এসে আবার বেদ প্রচার করেন। এই প্রত্যেক চতুর্যুগকে এক একটি কল্প বলা হয়।

চৌদ্দ জন মনুর নাম:

১। স্বায়দ্ভুব

২। স্বরোচিষ

৩। উত্তম

৪। তামস

৫। রৈবত

৬। চাক্ষুষ

৭। বৈবস্বত বা সত্যব্রত

৮। সাবর্ণি

৯। দক্ষ সাবর্ণি

১০। ব্রহ্ম সাবর্ণি

১১। ধর্ম সাবর্ণি

১২। রুদ্র সাবর্ণি

১৩। দেবতা সাবর্ণি

১৪। ইন্দ্র সাবর্ণি।

বিভিন্ন পুরাণ এ বিভিন্ন মনুর নাম দেখা যায়। মস্য পুরাণ এ মনুদের নাম:

১। স্বায়দ্ভুব (ব্রহ্মা ও গায়ত্রী হতে সম্ভূত)

২। স্বরোচিষ

৩। উত্তম

৪। তামস

৫। রৈবত

৬। চাক্ষুষ

৭। বৈবস্বত বা সত্যব্রত

৮। সাবর্ণি

৯। রোচ্য

১০। ভৌত

১১। মেরূ সাবর্ণি

১২। ঋভু

১৩। ঋতুধামা । প্রতি কল্পে এই চৌদ্দ মনুর আবির্ভাব হয়।

 জন্ম: সকল মনুই ধর্মশাস্ত্রকার। মনুদের মাঝে যিনি প্রথম, অর্থা স্বায়দ্ভব মনু, ইনি ব্রহ্মার মানসপুত্র, ব্রহ্মার দেহ হতে উদ্ভুত। স্বয়ং ব্রহ্মা নিজেকে বিভক্ত করে নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেন। এই নারী ও পুরুষ হতে পুরুষ বিরাজ উপন্ন হলেন এবং এই পুরুষ বিরাজ হতে স্বায়দ্ভব মনুর জন্ম হল।

অন্য কাহিনি মতে ব্রহ্মা নিজেই মনু রুপে সৃষ্ট হলেন এবং তার এক অংশে শতরূপা নামে নারী সৃষ্টি করলেন।

মনু দশ জন প্রজাপতি যথা

১। মরীচি

২। অত্রি

৩। অঙ্গিরা

৪। পুলস্ত্য

৫। পুলহ

৬। ক্রতু

৭। ভৃগু

৮। প্রচেতা

৯। নারদ

১০। বশিষ্ঠ

এরাই মানবের জন্মদাতা, মহর্ষি নামে খ্যাত। মরীচি প্রভৃতি হতে অন্য সাত মনু, অন্য দেবতা, যক্ষ, পিশাচ, নাগ, পক্ষী ও পিতৃগণ উপন্ন হন।

মনুসংহিতা: মনু ব্রহ্মার কাছ থেকে স্মৃতি শাস্ত্র পাঠ করে মরীচি প্রভৃতি কে পাঠ করান। এই স্মৃতি শাস্ত্র কে মানব ধর্মশাস্ত্র বলে। ভৃগু মনুর আদেশে এই ধর্মশাস্ত্র ঋষি দের নিকত ব্যাখা করেন। এর নাম মনুসংহিতা। এই সংহিতাকে হিন্দু আইনের ভিত্তিস্বরূপ বলা হয়।

 

সরস্বতী কি ব্রহ্মার স্ত্রী?

 

এই ভুল জেনে থাকলে পোষ্টটি আপনার জন্য!

 

আমরা যেমন- ব্যবসায়িক, বন্ধুত্ব বা বিবাহ এমনকি শিক্ষাগুরু ধরতে গেলেও তার সম্পর্কে ভালো করে জানার চেষ্টা করি এবং তারপর তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করি; তেমনি যখন কোনো দেব-দেবীর পূজা আমরা করবো, তখনও আমাদের উচিত সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তার আরাধনা করা, তাহলেই কেবল আমাদের পূজ-প্রার্থনা সফল ও সার্থক হবে।

 

সরস্বতী পূজা সম্পর্কে যেহেতু এই লেখা, সেহেতু প্রথমেই যে প্রশ্নের মিমাংসা করতে হবে যে, দেবী সরস্বতী আসলে কে ? আবার আমরা সাধারণভাবে অনেকেই কোনো দেব-দেবীকে ছোট এবং কোনো দেব-দেবীকে বড় বলে মনে করি, কিন্তু কোনো দেব-দেবী ই যে ছোট বড় নয়, সকল দেব-দেবী ই যে সমান, এই লেখাটি পড়লে এই তত্ত্বেরও একটা সংক্ষিপ্ত সমাধান পাবেন।

 

হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

 

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)

 

পরমব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমরা স্থূল দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিভক্ত করে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি এবং এই তিনটি সত্ত্বাকে আলাদা আলাদা তিনটি রূপ দান করেছি। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, এগুলো জাস্ট তিনটি নাম এবং এই তিনটি নাম পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র।

 

ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী। ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি যখন যে কাজ করেন, তখন সেই রূপের নামে কাজটি করেন, সেই তিনটি নামই হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।

 

এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিষ্ণুর আংশিক অবতার রাম কি যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? কৃষ্ণ কি ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তারই নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তারই নাম বিষ্ণু এবং যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তারই নাম শিব বা মহেশ্বর; যে কথা একটু আগেই বলেছি এবং যে কথা বলা আছে গীতার এই শ্লোকে-

 

“অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।

ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।”

 

অর্থ- পরমেশ্বরকে যদি যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবু তাঁকে সংহার কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

 

এতক্ষণে পাঠক-পাঠিকাদেরকে নিশ্চয় এটা বোঝাতে পেরেছি যে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কেউ নয়, তারা একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ; এই ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করেন তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেহেতু যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, সেহেতু প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমন কি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই!!

 

সরস্বতী কে? তিনি কি আসলেই ব্রহ্মার কন্যা?


 

এই প্রশ্ন নিয়ে কটুক্তি ও করা হয় এইভাবে যে, " তোরা যে সরস্বতী কে পুজা করিস সে তো তার পিতাকেই বিবাহ করেছে" এবং রেফারেন্স হিসেবে পুরাণ কে উল্লেখ করে।

 

আজকে এর সঠিক উত্তর  বেদের আলোকে ব্যাখ্যা দিচ্ছি,

 প্রথমে এটা জানুন সরস্বতী শব্দের উপত্তি কিভাবে?

(সৃ গতৌ) এই ধাতু হইতে "সরস্" তদুত্তর "মতুপ" এবং "ঙীপ" প্রত্যয় যোগে " সরস্বতী " শব্দ সিদ্ধ হয়।

 

  " সরো বিবিধং জ্ঞানং বিদ্যতে য়স্যাং চিতৌ সা সরস্বতী "

অর্থা, যাহার বিবিধ বিজ্ঞান অর্থা শব্দ, সমন্ধ ও প্রয়োগের যথাযথ জ্ঞান রয়েছে সেই পরমেশ্বর এর নাম 'সরস্বতী '।

 

অর্থা,  জ্ঞান প্রদানকারী পরমেশ্বর কে সরস্বতী নামে ডাকা হয়।

তিনি কারো কন্যা নন।

 

এইবার ব্যাখ্যায় আসি ব্রহ্মা কে?

(বৃহ বৃহি বৃদ্ধৌ) এই সকল ধাতু হতে 'ব্রহ্মা' শব্দ সিদ্ধ হয়।

  "য়ো খিলং  জগন্নির্মাণেন বর্হতি ( বৃংহতি) বদ্ধর্য়তি স ব্রহ্মা "।

  অর্থা, যিনি সমস্ত জগ রচনা করিয়া বিস্তৃত করেন সেই পরমেশ্বর এর নাম 'ব্রহ্মা'।

 

আবার তৈত্তিরীয়  উপনিষদে বলা হয়েছে, 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম'।

 

 তাহলে কি বুঝলেন? ব্রহ্মা বলুন বা সরস্বতী দুটোই পরমেশ্বর এর গুনবাচক নাম মাত্র।

এক পরমেশ্বর এর দুই নাম, তাহলে তারা কেউ কন্যা বা কেউ পিতা হয় কিভাবে?

 

এবার দেখুন বেদের মন্ত্রে অনেক জায়গায় সরস্বতী শব্দের উল্লেখ রয়েছে।

মন্ত্র গুলো দ্বারা জ্ঞান প্রদানকারী পরমেশ্বর সরস্বতী  কে স্তুতি করা হয়েছে। মন্ত্র গুলোর ব্যাখ্যা নিচে দিলাম-

 

  # মহা অর্ণঃ সরস্বতী প্র চেতয়তি কেতুনা।

 ধিয়ো বিশ্বা বি রাজতি।।

     ( ঋগ্বেদ ১/৩/১২)

অর্থা,  জ্ঞান প্রদানকারী পরমেশ্বর প্রজাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞানসমুদ্রকে প্রকাশ করে এবং ধারনাবতী বুদ্ধি সমুহ কে দীপ্তি দান করে।

 

# চোদয়িত্রী সুনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাম্।

     যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।

         (ঋগ্বেদ ১/৯১/৮)

অর্থা,  সত্য ও প্রিয়বানীর প্রেরণাদাত্রী এবং  বুদ্ধির চেতনাদাত্রী বিদ্যা শুভ কর্মকে ধারন করিয়া আছে।

 

# শংনো দেবা বিশ্বদেবা ভবন্তু শং সরস্বতী, সহ ধীতি রস্তু।

শমভিষাচঃ শমু রাতিষাচঃ শংনো দিব্যাঃ পার্থিবাঃ শন্নো অপ্যাঃ।।

          (ঋগ্বেদ ৭/৩৫/১১)

অর্থা,  জ্ঞানজ্যোতির রক্ষক বিদ্যানেরা আমাদের কল্যাণ বিধান করুন।  জ্ঞান প্রদানকারী পরমেশ্বর নানা প্রকার বুদ্ধির সাথে কল্যান দায়িনী হোক, বাহুবলে বলীয়াম এবং অন্যের আশ্রয়ে বলীয়ান দিব্য, পার্থিব এবং জলচর প্রানী দ্বারা আমাদের কল্যাণ করুক।

 

তখনকার দিনে ঋষিরা তথা সাধারন মানুষ  মুর্তি দিয়ে নয় বরং পরমেশ্বর কে 'সরস্বতী' নামে ধ্যান ও উপাসনা করত, জ্ঞান ও বিদ্যা লাভের জন্যে।

 

কালের বিবর্তনে সেটা মায়ের রুপ দিয়ে বর্তমানে বিদ্যার দেবী বলে পুঁজো করা হচ্ছে।

এমনকি তথাকথিত পুরান গুলোতে সরস্বতী শব্দের অনেক অপব্যাখা,  সৃষ্টি নিয়ে অনেক কাহিনী ও লিখা হয়েছে। যেগুলো নিয়ে আমাদের বরাবর বিভিন্ন কটুক্তি ও শুনার লাগে।

 

মনে রাখবেন, পুরান গুলো সনাতন ধর্মের মুল গ্রন্থ ও নয় এবং এইগুলো তৈরিকৃত কিছু কাহিনী নির্ভর মাত্র।

যেগুলো অনেক পরে লিখা হয়েছে।

 

কৃষ্ণা: ব্রহ্মার প্রথমা স্ত্রী সাবিত্রীর শাপে এই নদী হয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন বিষ্ণু

 

অধিকাংশ পুরাণ সরস্বতীকেই ব্রহ্মার স্ত্রী রূপে বর্ণনা করে। কিন্তু অনেকে আবার ব্রহ্মার প্রথমা স্ত্রী রূপে উল্লেখ করে সাবিত্রীর কথা। জানা যায়, তাঁকে বিবাহের পর একদিন ব্রহ্মা এক যজ্ঞ করবেন বলে মনস্থ করেন। তাই তাঁর আমন্ত্রণে যজ্ঞভাগ গ্রহণের জন্য বিষ্ণু এবং শিবের সঙ্গে সব দেবতারা সমবেত হন যজ্ঞস্থলে; ব্রহ্মাও সব উদ্যোগ শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সাবিত্রীকে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হওয়ার কথা জানান। কেন না, স্ত্রী ছাড়া যজ্ঞে বসা যায় না।

ও দিকে, সাবিত্রী তখন ব্যস্ত ছিলেন স্নানে। তিনি ব্রহ্মাকে যজ্ঞ শুরু করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন- স্নান শেষ করেই তিনি উপস্থিত হবেন সেখানে। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ব্রহ্মা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তাই ইন্দ্রকে তিনি এক যোগ্য কন্যা খোঁজার ভার দেন যাকে বিবাহ করে তিনি যজ্ঞ সমাপ্ত করতে পারবেন।

ব্রহ্মার নির্দেশে ইন্দ্র পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং এক অপূর্ব সুন্দরী গোয়ালার মেয়েকে দেখতে পান। তাঁর নাম গায়ত্রী। দেখা মাত্র ইন্দ্র তাঁকে হরণ করে নিয়ে আসেন দেবলোকে। সেখানে ব্রহ্মা তাঁকে বিবাহ করে যজ্ঞবিধি সম্পূর্ণ করেন।

এ দিকে প্রস্তুত হয়ে যজ্ঞস্থলে এসে ঘটনা দেখে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন সাবিত্রী! যজ্ঞ সমাপনের জন্য ধৈর্য ধরতে না পেরে ব্রহ্মা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন বলে ক্রুদ্ধা সাবিত্রী শাপ দেন- পৃথিবীতে পুষ্কর ছাড়া সব জায়গায় ব্রহ্মার উপাসনা নিষিদ্ধ হবে। পাশাপাশি, যজ্ঞপুরুষ বিষ্ণুর উপরেও বর্ষিত হয় তাঁর ক্রোধ, অভিশাপ দেন সাবিত্রী- বিষ্ণুকে নদী রূপে নেমে আসতে হবে পৃথিবীতে, কেন না প্রবাহিত জলধারার মতোই তিনি শুধু ঘটনা দেখে গিয়েছেন, ব্রহ্মাকে নিবৃত্ত করার কোনো উদ্যোগই নেননি!

বিষ্ণুকে সাবিত্রী যে শাপ দিয়েছিলেন, তার কিন্তু আরেকটি গূঢ় দিকও ছিল! নদ নয়, তিনি বিষ্ণুকে নদীতে রূপান্তরিত হওয়ার শাপ দিয়েছিলেন- একমাত্র তা হলেই তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন নারীর যন্ত্রণা! সেই মতো বিষ্ণুকে নদীরূপ ধারণ করে স্থান নিতে হয় মর্ত্যে, জলধারা তাঁর গাত্রবর্ণের মতোই ঘোর বলে নদীর পরিচিতি হয় কৃষ্ণা নামে!

 

দেব ব্রহ্মার স্তব

> আমরা জানি, সচ্চদানন্দ ভগবান নিরাকারতিনিই ব্রহ্মতাঁরই প্রকাশ ত্রিদেবরুপে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরতাঁর যোগমায়া

আর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধাযিনি আবার শক্তি রুপে অসুর বিনাশের নিমিত্তে আবির্ভূত হন সময়ের প্রয়োজনে

> তিন দেবতার মধ্যে ব্রহ্মাদেব জীব সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুদেব পালন করেন আর মহেশ্বদেব

বিনাশ বা সংহার করেনআর এই সমস্ত কিছুই ভগবান ব্রহ্ম' আদেশ বা নির্দেশ বা ইচ্ছা অনুসারেই হয়ে থাকেযদিও

আমরা এই তিন দেবকে ভগবান বলে মানি এবং ভক্তি সহকারে পূজা আরাধনা করে থাকিকিন্ত ব্রহ্মাপুত্র মহর্ষি নারদের

অভিশাপে ব্রহ্মাদেব কোনো জীব কর্তৃক পূজিত হন নাঅর্থাৎ তিনি কারও পূজা প্রাপ্ত হন নাআবার সৃষ্টির মহান কাজে

তিনি ভগবান কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্তসেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আরাধনা তুষ্ট করার জন্য ব্রহ্মাদেব

সর্বক্ষণ তাঁর গুণকীর্ত্তন স্তব্ধ করে থাকেনসেই স্তব্ধ আজ আমরাও অনুসরণ করার চেষ্টা করছি

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ব্রহ্মার স্তুতি:-


"ব্রহ্মা এষ জগদণ্ডবিধানকর্তা

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।"


অনুবাদঃ আমি যাঁর শক্তি পেয়ে এই ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা হয়েছি সেই আদি পুরুষ গোবিন্দ শ্রীকৃষ্ণকে আমি ভজনা

করি

(ব্রহ্মসংহিতা/৫/৪৯)


"আলোলচন্দ্রক লসদ্ বনমাল্য বংশী

রত্নাঙ্গদং প্রণয়কেলিকলাবিলাসম্

শ্যামং ত্রিভঙ্গললিতং নিয়তপ্রকাশং

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।"


অনুবাদঃ দোলায়িত ময়ূরপুচ্ছ শোভিত বনমালা তাঁর গলদেশে, তাঁর দুই হাতে বংশী রত্নাঙ্গদ, তিনি সর্বদা প্রনয়

কেলিকলা বিলসে সুনিপুণ, অত্যন্ত ললিত ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে তিনি দন্ডায়মান হনতিনি শ্যামসুন্দর রূপে নিয়ত প্রকাশমান

সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি

(ব্রহ্মসংহিতা/৫/৩১)


"তাবদ্ রাগাদয়ঃ স্তেনাস্তাবৎ কারাগৃহং গৃহম্

তাবন্মোহোহঙ্ঘ্রি নিগড়ো যাবৎ কৃষ্ণ তে জনাঃ।।"


অনুবাদঃ হে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, যতক্ষণ মানুষ আপনার ভক্ত না হয়, ততক্ষণ তাদের জড় আসক্তি বাসনা হয়ে থাকে

তস্করস্বরুপ, তাদের গৃহাদি কারাগার স্বরুপ এবং তাদের পারিবারিক আসক্তি জনিত মোহ পায়ের শৃঙ্খলস্বরুপ হয়ে থাকে

(ভাগবত/১০/১৪/৩৬)

 

ব্রহ্মা ও সরস্বতীদেবীকে নিয়ে মুসলিমদের অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব!

বর্তমানে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরীদের দারুন আগ্রহের বিষয় হলো হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর ভূমিকা।

এদের কারো কারো কাছে সরস্বতী- ব্রহ্মার কন্যা; কারো কাছে আবার সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনী। আগে তো ঠিক কর সরস্বতী- ব্রহ্মার কে, তারপর তাদের সম্পর্কে কাহিনী বানা। কেউ কেউ আবার বলে, স্বর্গের নর্তকী উর্বশীকে দেখে ব্রহ্মা নাকি এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়তো যে, সে হস্তমৈথুন করতো এবং সেই হস্তমৈথুন জাত বীর্য নাকি সে আবার একটা পাত্রে সংরক্ষণ করতো, সেই পাত্র থেকেই নাকি জন্ম ঋষি অগস্ত্যর । এরা কখনো ব্রহ্মাকে মানুষ বানাচ্ছে, যে মানুষ সুন্দরী নারীকে দেখে উত্তেজিত হয়, কাম সামলাতে না পেরে হস্তমৈথুন করে; আবার এরাই ব্রহ্মাকে মহাশক্তিশালী দেবতা বানাচ্ছে, যে দেবতা পাত্রে জড়ো করে রাখা বীর্য থেকে কারো জন্ম দিতে পারে। আগে তো ঠিক কর ব্রহ্মা- মানুষ না দেবতা, তারপর তার সম্পর্কে গল্প বানা।

মুসলিমদের অপপ্রচারের নমুনা:

বেদ পুরানে যা ই থাক, হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বকে উপলব্ধি করার বা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তাদের থাক বা না থাক মুসলমানরা বিশ্বাস করে সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা এবং এই ব্রহ্মা ও সরস্বতীর যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। গল্পটা বেশ রসালো আর আকর্ষণীয়ও, তাই বোধহয় এটা নিয়ে এত চর্চা।

মানুষ দুটো কারণে কোনো কিছুর চর্চা করে;

প্রথম হলো বিষয়টা তার কাছে খুব ভালো লেগেছে, তাই সে সেটা নিয়ে আলোচনা করে অন্যের সাথে তার সেই আনন্দকে ভাগ করতে চায়; আর
দ্বিতীয় কারণ হলো ঈর্ষা, ওর আছে ও পাচ্ছে; আমার নেই, আমি পাচ্ছি না কেনো- এই ঈর্ষা।
বেদ এর ভুল ব্যাখ্যায় পুরানের এই বিকৃত গল্প নিয়ে হিন্দুদের কোনো মাথা ব্যাথা বা আগ্রহ না থাকলেও এর প্রতি মুসলমানদের এই প্রবল আগ্রহের কারণ হলো এই ঈর্ষা। তাদের মতে, ব্রহ্মা তার কন্যা সরস্বতীর সাথে সেক্স করতে পেরেছে, তাহলে আমরা পারছি না কেনো ? ঈর্ষার কারণ মূলত এটাই।

কিন্তু এটা নিয়ে এত হতাশায় ভোগার কী আছে ? ইসলামে তো দত্তক নেওয়া কন্যাকে বিয়ে করার পারমিশন আছে, কন্যাসমরা তো কন্যাই, সেটা দত্তক হোক আর নিজের হোক। তো সেই দত্তক নেওয়া কন্যাকে বিয়ে করতে পারলে নিজের কন্যাকে বিয়ে করতে দোষ কোথায় ? ইসলামের স্বীকৃত নবী হযরত লুত এর উদাহরণ তো আছেই; কারণ বাইবেলের অংশ জেনেসিস এর ১৯/৩৩-৩৬ তে বলা আছে, “স্ত্রী মারা গেলে হযরত লুত তার বয়স্ক দুই কন্যার গর্ভে পুত্র উপাদন করেছিলো”- তাই, এত হায় হুতাশ না করে হযরত লুত এর উদাহরণটা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ কর না ?

বেদ এর সূত্রকে অবলম্বন করে পুরানের গল্পগুলো রচিত। কিন্তু যারা পুরানের গল্পগুলো লিখেছিলো, তারা যে বেদ এর ভাষ্যকে ঠিক মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিলো, এই বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আবার এটাও হতে পারে দীর্ঘদিন মুসলিম দুঃশাসনের অধীনে থাকার কারণে পুরানের গল্পগুলো বিকৃত হয়েছে; কারণ, মুসলমান শাসকদের লক্ষ্যই ছিলো হিন্দুধর্ম ও জাতিকে ধ্বংস করা, এজন্য তারা শুধু হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলোকে বিকৃতই করে নি, নতুন নতুন পুরান নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করিয়ে হিন্দুধর্মের গ্রন্থ বলে চালিয়ে দিয়েছে। এরকম কয়েকটি গ্রন্থহলো- ভবিষ্যপুরান, আল্যাউপনিষদ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান এবং এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে মুসলমান শাসকদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয় জয়দেব এর গীত গোবিন্দ, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং বৈষ্ণব পদাবলী

ভারতে ছাপাখানা আসার আগে প্রয়োজনীয় সমস্ত গ্রন্থ হাতে লিখে নতুন কপি বানানো হতো। যাদের হাতের লেখা ভালো ছিলো তারা এই কাজটা করতো, অনেকের এটা পেশাও ছিলো। এরা কখনো কখনো মূল বই লিখতে লিখতে তাতে নিজের কথা ঢুকিয়ে দিতো, এভাবেও হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলো বিকৃত হয়েছে। কিন্তু এই লিপিকারদের হাতে বেদ এর বিকৃতি তেমন হয় নি, কোলকাতার ব্রাহ্ম সমাজ এর বুদ্ধি ও সহযোগিতায়

বেদ এর বিকৃতি ঘটিয়ে প্রিন্ট করে ইংরেজরা। কিন্তু লিপিকারদরে হাতে ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে পুরানের গল্পগুলির, শুধু তাই নয়, তাতে যোগ হয়েছে নতুন গল্প এবং গল্পের শাখা প্রশাখা। আজকের প্রসঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মা ও সরস্বতী, সেহেতু এই প্রসঙ্গেই পুরানের গল্পগুলির যে কী হাল, তার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি-

পুরাণের একটি কাহিনী অনুযায়ী, স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশীকে দেখে স্বমেহন মানে হস্তমৈথুন করতেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার শুক্রাণু জমা হতো একটি পাত্রে। সেই পাত্রেই জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্যর এবং পরবর্তীতে অগস্ত্য জন্ম দেন সরস্বতীর। এই সূত্র অনুযায়ী - সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনী।

এখন আপনি ই বলুন, ব্রহ্মা কি মানুষ, যে সুন্দরী কোনো নারীকে দেখে তার কাম জাগ্রত হবে আর সেই কামকে প্রশমিত করার জন্য সে স্বমেহন করবে ? এরপর বলা হচ্ছে ব্রহ্মার শুক্রানু জমা হতো একটি পাত্রে, সেই পাত্র থেকে জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্যের। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র মতে মূল তত্ত্ব হচ্ছে, ব্রহ্মা তার মনের শক্তি দ্বারাই তার পুত্রদের সৃষ্টি করতে পারতেন, এজন্যই তাদেরকে বলা হয় ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মার চরিত্রে আরোপিত এই যে বিপরীত ধর্মী ঘটনা, এটা কিভাবে সম্ভব ? কারো মধ্যে যদি এই ক্ষমতা থাকে যে, সে তার চিন্তা শক্তির দ্বারাই কাউকে হত্যা করতে পারে, তাহলে সে ম্যানুয়ালি চাপাতি নিয়ে কাউকে হত্যা করতে যাবে কেনো ?

এই কাহিনী অনুযায়ী পাত্র থেকে উদ্ভূত ঋষি অগস্ত্য জন্ম দেয় সরস্বতীর। তাহলে নিশ্চয় সরস্বতীর একজন মা থাকা চাই, কিন্তু সরস্বতীর মায়ের খবর কেউ কি জানেন ? কিন্তু ঋষি অগস্ত্যের একজন স্ত্রী ছিলো, নাম লোপামুদ্রা। সেই হিসেবে লোপামুদ্রা সরস্বতীর মা হওয়ার কথা। কিন্তু এমন কথা কেউ কখনো কি শুনেছেন ? আরেকটি কাহিনী অনুযায়ী অপ্সরা উর্বশীকে দেখে কোনো এক যজ্ঞকুম্ভে বীর্যপাত হয় আদিত্য ও বরুনের। সেই যজ্ঞকুম্ভ থেকে অগস্ত্য ও বশিষ্ঠের জন্ম হয়। মূল কাহিনী অনুযায়ী এই বশিষ্ঠ কিন্তু আবার ব্রহ্মার মানসপুত্রদের একজন। চিন্তা করুন অবস্থা!

এইভাবে পুরানের গল্পগুলোর গরু শুধু গাছেই নয়, আকাশেও চড়ে বেরিয়েছে। এজন্যই পুরানের গল্পগুলো শুধুই গল্প, এগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এবং এই গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তেও আসা যায় না। কিন্তু এই পুরানগুলো আবার মহর্ষি বেদব্যাসের নামেই বাজারে প্রচলিত, এখন আপনিই চিন্তা করুন, যে বেদব্যাস মহাভারতের মতো একটি বিশুদ্ধ মহাকাব্যের রচয়িতা, যে মহাকাব্যে একটিও ভুল না থাকার কারণে ছোটখাটো কোনো ত্রুটি বিচ্যুতিতে- “মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে” ব’লে প্রবাদ বাক্যের উপত্তি, সেই মহাভারত রচয়িতা কি এমন সব গাঁজাখোরি পুরানের গল্প লিখতে পারে ? এসব বিচারে স্পষ্ট যে, বর্তমানে বাজারে প্রচলিত সব পুরাণ হিন্দুধর্মের প্রামান্য গ্রন্থ নয়

 আবার অন্য একটি কাহিনী মতে, ব্রহ্মার শুক্রাণু থেকে সরাসরি জন্ম হয় সরস্বতীর। কিন্তু নিজের মেয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হন পিতা প্রজাপতি ব্রহ্মা। সরস্বতী বড় হলে তাঁর সঙ্গে সে যৌনসঙ্গম করতে চায়। জন্মদাতার কামনা থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে সরস্বতী। সরস্বতী ব্রহ্মার চোখের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তার উপর নজর রাখতে নিজের ঘাড়ের উপর পাঁচদিকে পাঁচটি মাথা তৈরি হয়ে যায় ব্রহ্মার। সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নানা পশুর ছদ্মবেশ ধরে পালাতে থাকে। ব্রহ্মাও একে একে সেইসব পশুর পুরুষ রূপ ধারণ করে সরস্বতীর পিছু নেয়। বলা হয়, এইভাবেই তৈরি হয় জীবকূল। সরস্বতী বাঁচতে একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেয়। ব্রহ্মা সেই গুহাতেই মিলিত হন সরস্বতীর সঙ্গে। সরস্বতী ছিলো ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু তার সঙ্গেই মিলিত হন ব্রহ্মা। এই অবৈধ যৌনাচারের অপরাধে শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মাথাটি কেটে দেন এবং অভিশাপ দেন যে, ধরাধামে কেউ ব্রহ্মার পূজা করবে না।

এই জন্যই নাকি পৃথিবীতে শিব ও বিষ্ণুর পূজার প্রচলন থাকলেও ব্রহ্মার পূজার প্রচলন নেই। যেমন ঘটনা, তেমনি সেই ঘটনার পেছনের কাহিনীর ব্যাখ্যা!

এই কাহিনীতে বলা হচ্ছে, ব্রহ্মার শুক্রানু থেকে জন্ম হয় সরস্বতীর। তাহলে শুক্রানুর সাথে তো ডিম্বানুরও প্রয়োজন হবে, তাহলে সেই ডিম্বানুটা কার ? পরে বলা হলো, সরস্বতী বড় হলে তার রূপ মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মা তার সাথে সেক্স করতে চায়। এখানে বোঝা যাচ্ছে, মানব সন্তানের মতো শিশু রূপেই সরস্বতীর জন্ম হয়েছে, তাহলে তার মা কে ? সরস্বতী শিশু ছিলো, বড় হলে তার প্রতি তার পিতা ব্রহ্মা আকৃষ্ট হয়, তার মানে সরস্বতী এক পর্যায়ে বৃদ্ধা হয় এবং মারাও যায়, তাহলে তার মৃত্যুর ইতিহাসটা কোথায় ?

আরো বলা হচ্ছে, ব্রহ্মার চোখের আড়াল হওয়ার জন্য সরস্বতী লুকানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু তার উপর নজর রাখার জন্য ব্রহ্মার পাঁচদিকে পাঁচটি মাথা তৈরি হয়। যে ব্রহ্মা মন থেকেই সব সৃষ্টি করতে পারে, যার মনের এত ক্ষমতা, তার চোখের আড়াল হওয়া কি সম্ভব ? সরস্বতী যাতে চোখের আড়াল না হতে পারে, সেজন্যই নাকি ব্রহ্মার ঘাড়ের উপর পাঁচটি মাথা তৈরি হয়, কিন্তু দিক তো চারটি, তাহলে পাঁচটি মাথার প্রয়োজন হলো কেনো ? নাকি পৃথিবীতে ব্রহ্মার পূজার প্রচলন কেনো নেই, সেই ব্যাখ্যা দেবার জন্য ব্রহ্মার উপর একটি অভিশাপের গল্পের প্রয়োজন ছিলো, সেজন্য ব্রহ্মার পাঁচটি মাথার গল্প বানিয়ে তা থেকে শিবের মাধ্যমে একটি মাথা কেটে ফেলা হয়েছে এবং ব্রহ্মার উপর শিবের অভিশাপকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আষাঢ়ে গল্পকাররা বোধহয় জানতো না যে, উপত্তির দিক থেকে শিবের চেয়ে সিনিয়র হলো ব্রহ্মা। যদিও শিব এবং ব্রহ্মা একই লেভেলের দেবতা, কিন্তু মন্ত্রীসভার- বয়সে জুনিয়র কোনো পূর্ণমন্ত্রী কি, তার চেয়ে সিনিয়র কোনো পূর্ণমন্ত্রীর উপর ক্ষমতা খাটাতে পারে ? দুজনই তো পূর্ণমন্ত্রী, তাদের ক্ষমতাও এক ?

এরপর বলা হচ্ছে, সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নানা পশুর ছদ্মবেশ ধরে পালাতে থাকে, ব্রহ্মাও একে একে সেইসব পশুর পুরুষ রূপ ধারণ করে সরস্বতীর পিছু নেয় এবং এইভাবেই তৈরি হয় জীবকূল বা প্রাণীজগ

পুরান রচয়িতারা যেহেতু আগেই বলে দিয়েছে যে, ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলো সরস্বতী, তাই তাদেরকে সরস্বতীর এই নানা ছদ্মবেশ ধারণের সাথে সাথে তাকে পালানোর ভূমিকায় দেখাতে হয়েছে। কিন্তু আমি যখন এর মূলকাহিনী এই পোস্টের শেষের দিকে বর্ণনা করবো, তখন বুঝতে পারবেন আসলে প্রকৃত ঘটনাটা কী ?

এরপর বলা হচ্ছে, সরস্বতী বাঁচতে একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেয়। ব্রহ্মা সেই গুহাতেই মিলিত হন সরস্বতীর সঙ্গে। যে মন থেকেই সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে, যে চাওয়া মাত্রই তার মাথার পাশে আরও চার/পাঁচটি মাথার গজিয়ে যায়, তার হাত থেকে পালিয়ে গুহার ভেতর আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা কি বৃথা নয় ?

এরপর একটি পদ্মফুল সরস্বতীর সাথে নাকি ব্রহ্মা ১০০ বছর ধরে মিলিত হয় এবং তাদের কয়েকটি ছেলে মেয়েও হয় এবং এখানে মুসলমানদের অভিযোগ হচ্ছে, তাদের ভাষায় পিতা ব্রহ্মার সাথে সরস্বতী এই যৌনক্রিয়া কখনোই করতে চায় নি, তাই এটা এক প্রকারের ধর্ষণ। যদিও এটা কাহিনীর স্বীকৃতি নয়, তবুও শুধু তর্কের খাতিরে বলছি, সরস্বতীর যদি ইচ্ছাই না থাকতো তাহলে সে ঐ গুহা থেকে বের হয়ে পদ্মফুলে হানিমুন করতে এলো কেনো ? আর এই পদ্মফুলটা কত বড় ছিলো আর কোনো সরোবরে ছিলো, যে তা ১০০ বছর ধরে জীবিত ছিলো আর কয়েকজন মানুষের সংসারকে ধারণ করে রাখতে পারলো ? নব্য হিন্দু ধর্মজ্ঞানীদেরকে বলছি, এই পোস্টে উল্লেখ করা আমার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর মরদ হলে দিয়ে যাবেন, আর দিতে না পারলে বুঝবো, যারা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সব কিছু না জেনে পুরানের কিছু বিকৃত ও অতিরঞ্জিত কাহিনী নিয়ে হিন্দু ধর্মকে দোষারোপ করে তারা…………।

এক একজন দেব-দেবীকে নিয়ে যত পুরান লিখা হয়েছে তার প্রত্যেকেটিতে তাদেরকে আলাদা আলাদা ঘটনায় উপস্থাপিত করা হয়েছে। তাই কোনো পুরানের সাথে কোনো পুরানের গল্পের হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিল নেই, যদিও দেব-দেবী সব এক, এটা কিভাবে সম্ভব ? সম্ভব এ্ই ভাবেই যে, হয়- পুরান রচয়িতারা বেদকে ঠিক ভাবে বুঝতে পারেনি, না হয় পরবর্তীতে লিপিকারদের হাতে পুরানগুলো বিকৃত হয়ে কাহিনীর নানা রূপ লাভ করেছে।

এবার অপপ্রচারের জবাব দেয়া যাক

এখন হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব মতে, ব্রহ্মা ও সরস্বতীর আসল স্টোরিটা কী, দেখুন :

হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)

এই ব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমাদের পুরান রচয়িতারা বেদ এর সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে বুঝতে না পেরে, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে তিনটি আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করে নিয়ে তাদেরকে আলাদা আলাদা রূপ দিয়ে দিয়েছে, শুধু তাই নয় তাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদও লাগিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে মানুষ রূপে কল্পনা করে তাদের দিয়ে আরো যা করিয়েছে তা তো উপরে করা বর্ণনায় কিছুটা বুঝতেই পারলেন।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী; ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী, কিন্তু তিনি কাজ করেন সাধারণ মন্ত্রী হয়ে, সাধারণ মন্ত্রীর নামে।

এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাম কী যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়।

যা হোক, ব্রহ্মের ব্রহ্মা রূপের কাজ হলো সৃষ্টি করা। তো সৃষ্টি করতে লাগে নারী ও পুরুষ সত্ত্বা। সরস্বতী হলো পুরুষরূপী ব্রহ্মার নারী শক্তি। যে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে লাগে জ্ঞান, এজন্য সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে। কোনো কিছু সৃষ্টি করার সময় সবদিকে নজর রাখতে হয়, এই সবদিকে নজর রাখার প্রতীক হিসেবে ব্রহ্মার চারমাথা। উপরেই পড়েছেন, ব্রহ্মার কাছ থেকে বাঁচার জন্য সরস্বতী বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধরে পালাতে থাকে আর তার পিছু পিছু ঐ প্রাণীর পুরুষ রূপ ধরে ব্রহ্মা তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে, এভাবেই সৃ্ষ্টি হয় জীবকূল; এটা আসলে বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। দৌড়াতে দৌড়াতে সরস্বতী গিয়ে আশ্রয় নেয় গুহার মধ্যে; এটা হলো, বিবর্তনের শেষ ধাপ মোটামুটি আধুনিক মানুষের গুহার জীবন এবং তারপর পদ্মফুলে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর বাস এবং তাদের ছেলে মেয়ের জন্ম আসলে আধুনিক সভ্য মানুষের জীবন যাপনের প্রতীক।

এইভাবে হিন্দু শাস্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদ খুবই প্রতীকী রূপে ও সংক্ষিপ্তভাবে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে না বুঝে আমাদের পুরাণ রচয়িতারা যেন-তেন ভাবে সেগুলোকে ব্যাখা করতে গিয়ে যা-তা কাহিনী বানিয়ে ফেলেছে, আর পরবর্তী লিপিকারদের হাতে সেগুলো শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে নানা ভাবে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। আর এই সব বিকৃত পুরানের বিকৃত গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে বর্তমানের যৌন উন্মাদ মুসলমান পুরাণ রচয়িতারা এর সাথে যুক্ত করেছে যৌনতার নানা গল্প।

যৌনতায় মুসলমানদের যেমন কোনো নীতি নৈতিকতা নেই, তেমনি তাদের চিন্তারও ও কোনো নীতি নৈতিকতা নেই, তাই তারা সরস্বতীকে কখনো বানায় ব্রহ্মার মেয়ে, কখনো নাতনী, এই মেয়ের বা নাতনীর উপর কামলালসা চরিতার্থতা করার জন্য ব্রহ্মাকে নিজেদের মতো করে বানায় লম্পট, চরিত্রহীন, যে সুন্দরী নারী দেখে হস্তমৈথুন করে, কন্যার সাথে সেক্স করার জন্য তার পিছু দৌড়ায়, আরও কত কী ? আসলে যার যে রকম মন, সে বা তারা তো সেরকমই চিন্তা করবে, মুসলমানরা করেছে ঠিক তাই। তাই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মের ব্রহ্মারূপকে তারা বানিয়েছে নীচু শ্রেণীর মানুষ, আর তার নারীশক্তি সরস্বতী, তাদের কাছে ব্রহ্মার স্ত্রীও নয়, কন্যা-নাতনী! যেন গল্পটা আরো ভালো জমে আর তা দিয়ে প্রমান করা যায় যে হিন্দুধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব কত নোংরা, জঘন্য; কিন্তু এসব করতে গিয়ে তাদের নিজেদের পাছার কাপড় যে খুলে যাচ্ছে, যাবে, সেটা তারা বোধহয় কখনোই ভাবে নি। কারণ,

ইসলামকে বড় করে তোলার জন্য জাকির নায়েক মার্কা মুসলমানদের এই যে বাড়াবাড়ি, সেই বাড়াবাড়ির জবাব দিতে গিয়েই নতুনভাবে জন্ম হয়েছে, আমার এবং আমার মতো আরো অনেকের, এজন্য হিন্দু ধর্মের প্রকৃত সত্য যে শুধু বের ই হয়ে আসছে, তাই নয়, উন্মোচন হচ্ছে ইসলামেরও অন্ধকার দিকগুলো এবং আরো হবে, এখন সময় শুধু অপেক্ষার, ইসলামের পতনকে দেখার।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ