সরস্বতী

 

কোনো সনাতন ধর্মালম্বীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, দেবী সরস্বতী কে? বলবে, জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী। আর?

 

আর কোনো তথ্য তার কাছে নেই। এরপর হয়তো দু’চার জন হিন্দু বলবে যে, সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই বা কিছু হয় না। তাহলে- দেবী সরস্বতী কে?

পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকারী রূপের নাম ব্রহ্মা আর ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম সরস্বতী; এর মানে হলো সরস্বতীই ব্রহ্মা, আর ব্রহ্মা মানেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, অর্থাৎ সরস্বতীই পরমেশ্বর বা ঈশ্বর।

অনেকেই সরস্বতীকে ছোট দেবী হিসেবে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে দেব-দেবীদের মধ্যে ছোট বা বড় বলে কিছু নেই, সব দেব-দেবী ই সমান; সুতরাং সরস্বতী, ঈশ্বরেরই একটা রূপের নাম এবং স্ত্রীলিঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরীরূপে সরস্বতীই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর।

 

সরস্বতীর গায়ের রং সাদা কেনো?

 

দেবী সরস্বতীর শুভ্রমূর্তি নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক; এটা এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী; যে ছেলে মেয়ে বাল্যকাল থেকে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখার চেষ্টা করবে, সে যে সারাজীবন তার সকল কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই।

 

সরস্বতীর সাথে রাজহাঁস থাকে কেনো?

রাজহাসেঁর মধ্যে এমন ক্ষমতা আছে যে, এক পাত্রে থাকা জল মিশ্রিত দুধের থেকে সে শুধুমাত্র দুধ শুষে নিতে পারে।সরস্বতী যেহেতু শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট পূজা, সেই প্রেক্ষাপটে এটা বলা যেতে পারে যে, রাজহাসেঁর এই তথ্য শিক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, সমাজে ভালো মন্দ সব কিছুই থাকবে, তার মধ্যে থেকে তোমাদেরকে শুধু ভালোটুকু শুষে নিতে হবে। অধিকাংশ হিন্দু ছেলে-মেয়েরা যে মেধাবী এবং চরিত্রবান বা চরিত্রবতী, সরস্বতী পূজা এবং তার রাজহাঁসজনিত এই শিক্ষাই তার কারণ।

 

সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে কেনো?

এর কারণ হচ্ছে-হিন্দু ধর্ম হলো নাচ, গান সমৃদ্ধ শিল্পকলার ধর্ম; যা সামাজিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে সাপোর্ট করে। কারণ, প্রত্যেক ছেলে মেয়েই কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহন করে; প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে হিন্দুধর্ম এই সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে, এই কারণেই দেবী সরস্বতীর হাতের বীণা হচ্ছে সেই শিল্পকলার প্রতীক।

আর এটা সুধীজন স্বীকৃত যে, যারা- নাচ, গান, কবিতা লেখা বা নাট্যচর্চার মতো শিল্পকলার সাথে জড়িত, তারা সাধারণত কখনো মিথ্যাও বলে না; চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ তো দূরের ব্যাপার।

 

 

সরস্বতীর হাতে পুস্তক থাকে কেনো?

 

পুস্তক হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার বা জ্ঞানের বাস হলো পুস্তকে। যেহেতু সরস্বতী হলো জ্ঞানের দেবী, তাই তার হাতে থাকে পুস্তক বা পূজায় পাঠ্যপুস্তক দিতে হয়। পৃথিবীতে হিন্দুরাই একমাত্র জাতি যারা জ্ঞানার্জনের জন্য পূজা প্রার্থনা করে। একারণেই হিন্দুরা একটি জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ জাতি। এখনও যেকোনো স্কুলে যে কয়জন হিন্দু ছাত্র ছাত্রী পাওয়া যাবে, দেখা যাবে তাদের মধ্যে৯০% ই জিনিয়াস।

 

সরস্বতীর দুই হাত না চার হাত ?

 

বর্তমানে দেবী সরস্বতীকে দুই হাত বিশিষ্ট দেখা গেলেও দেবী সরস্বতীর মূল মূর্তি আসলে চার হাত বিশিষ্ট, এরকম ছবি আপনারা অনেকে জায়গায় দেখলেও দেখে থাকতে পারেন, সরস্বতীর মূল থিমের সাথে এই চার হাত ই মানানসই; কারণ হলো- পড়াশুনার পাশাপাশি কেউ যদি নাচ গান বা অন্য যে কোনো শিল্পকলায় এক্সপার্ট হতে চায়, তাকে দুই হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করলে চলবে না, তাকে চার হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করত হবে।

 

সরস্বতীর আসন, রাজহাঁস, না পদ্মফুল ?

 অনেক কাঠামোতে দেখা যায়, সরস্বতী দেবী হাঁসের উপর বসে আছে আবার কোনো কাঠামোয় দেখা যায় পদ্মফুলের উপর; পদ্মফুলের উপ সরস্বতীর আসন ই সঠিক আসন। এর কারণ- পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মফুল হলো সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীক; এই কারণেই লেখা হয়েছে-

“ফুলের মতো গড়বো মোরা মোদের এই জীবন” এই ধরণের কবিতা। এককথায় ফুলের বিকাশের সাথে মানুষের জীবনের বিকাশকে তুলনা করা হয়েছে। পূর্ণ বিকশিত একটি পদ্মফুলের উপর সরস্বতীর বসে থাকার মানে হলো- সরস্বতীর আদর্শকে লালন করে নিজের জীবনকে বিকশিত করতে পারলে সেই জীবনও ফুলের মতোই পবিত্র, সুন্দর, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হবে।

 

সরস্বতী কেনো মাতৃ মূর্তি ?

স্বয়ং ঈশ্বর হলেও সরস্বতী নারী মূর্তি অর্থা মাতৃমূর্তি, এর কারণ হলো- পিতার চেয়ে মায়ের কাছে কোনো কথা বলা সহজ বা কোনো কিচু চাওয়া সহজ। সরস্বতীর পূজারীরা যেহেতু সাধারণভাবে শিশু বা বালক-বালিকা অর্থা শিক্ষার্থী, তাই তারা যাতে সহজে নিজের মনের কথা নিজের মনের আকুতি, দেবী মায়ের কাছে জানাতে পারে, এজন্যই সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে মাতৃরূপে।

 শেষে একটা ছোট্ট তথ্য- বৌদ্ধ মতবাদ যেহেতু সনাতন ধর্ম থেকে উদ্ভূত, সেই কারণেই হোক বা হিন্দুদের জ্ঞান অর্জনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখেই হোক, বৌদ্ধরাও সরস্বতী পূজা করে।

 

 

সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী 

সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থা নদী। সরস্বতী শব্দটির বুপত্তিগত অর্থে সরস+বতু আর স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সরস্বতী। তিনি বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া প্রভৃতি নামে অভিহিতা। তাঁর এক হাতে বীণা অন্য হাতে পুস্তক।

বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন এ ধরাতে। কালের বিবর্তনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থা জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন। সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী। ঋগবেদে তিনি বৈদিক সরস্বতী নদীর অভিন্ন এক রূপ। পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী পরে হলেন দেবী। এ বিষয়ে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন তেমনি সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। সরস্বতীর প্রকৃত তাপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদী রূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তত্ত্ব।

বর্তমানে সরস্বতীর বাহন হাঁস। পণ্ডিত কলহনের মতে, সরস্বতী দেবী হংসের রূপ ধারণ করে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন। এ ধরনের ধারণা সঙ্গত কারণ হংসবাহনা সরস্বতীর মূর্তি তো প্রচুর পাওয়া যায়। তিনি এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহন কিন্তু পাখি নয়। বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যে সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য একেবারেই যুক্তিসঙ্গত কারণে। তবে বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নিলেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর। পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দিলেন। আর সরস্বতীর এ বাহন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর সমান গতি ঠিক যেমনভাবে জ্ঞানময় পরমাত্মা সব জায়গায় বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হলো হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুধ বা ক্ষীরটুকু গ্রহণ করে  আর জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনায় হাঁসের এ স্বভাব যথেষ্ঠ তাপর্য বহন করে। তাই বিদ্যাদেবীর বাহন হিসেবে হাঁসকে খুব ভালোই মানায়।

হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই তাঁর অপর নাম বীণাপাণি। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই মায়ের হাতে বীণা।

হিন্দুদের দেবী হয়েও বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছ থেকেও পূজা পেয়েছেন সরস্বতী। অনেক বৌদ্ধবিহারেও সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং  ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অনন্যা মা সরস্বতী। সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন হয়। সরস্বতী পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় আলাদা কিছু সামগ্রী যেমন : অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ ছাড়াও লাগে বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগ পর্যন্ত কূল খেতে পারে না। দেবীকে নতুন বছরের কূল দিয়ে তবেই কূল খায় ছাত্রছাত্রীরা। পূজার আগের দিন সংযম পালন অর্থা সংযমের দিন মাছ-মাংস পরিহার করে নিরামিষ খাওয়া বাঞ্চনীয়। তবে সব মিলে এসব আচার-অনুষ্ঠানেও রয়েছে আনন্দ।

পূজার দিন লেখাপড়া একেবারেই নিষেধ থাকে। পূজার পরে দোয়াত-কলম পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রের পূজারও প্রচলন আছে। এ দিনেই অনেকের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। পূজা শেষে অঞ্জলি দেওয়াটা খুব জনপ্রিয়। আর যেহেতু সরস্বতী বিদ্যার দেবী তাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ উসব অনেক বড় করে পালিত হয়। আর সেখানে দল বেঁধে অঞ্জলি দেয় শিক্ষার্থীরা। মানুষের ভেতরের পশুকে নিবৃত্ত করে জ্ঞান দান করেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী। মা সরস্বতীর জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী, ললিতকলার দেবী। কয়েক দিন ধরেই এ পূজাকে ঘিরে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দিত থাকে।

মা সরস্বতী আমাদের আশীর্বাদ করছেন- জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র রাখ। সত্যকে আঁকড়ে রাখ। মূল গ্রন্থের বাণী পালন কর। জীবন ছন্দময় কর। স্বচ্ছন্দে থাক।’ এ বিশ্বের সবাই মনের কলূষতা দূর করে জ্ঞানের আলোয় নিজেকে ও অন্যকে আলোকিত করুক মা সরস্বতীর কাছে এই প্রার্থনাই করি।

 

সরস্বতী কি ব্রহ্মার স্ত্রী?

 

আমরা যেমন- ব্যবসায়িক, বন্ধুত্ব বা বিবাহ এমনকি শিক্ষাগুরু ধরতে গেলেও তার সম্পর্কে ভালো করে জানার চেষ্টা করি এবং তারপর তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করি; তেমনি যখন কোনো দেব-দেবীর পূজা আমরা করবো, তখনও আমাদের উচিত সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তার আরাধনা করা, তাহলেই কেবল আমাদের পূজ-প্রার্থনা সফল ও সার্থক হবে।

 

সরস্বতী পূজা সম্পর্কে যেহেতু এই লেখা, সেহেতু প্রথমেই যে প্রশ্নের মিমাংসা করতে হবে যে, দেবী সরস্বতী আসলে কে ? আবার আমরা সাধারণভাবে অনেকেই কোনো দেব-দেবীকে ছোট এবং কোনো দেব-দেবীকে বড় বলে মনে করি, কিন্তু কোনো দেব-দেবী ই যে ছোট বড় নয়, সকল দেব-দেবী ই যে সমান, এই লেখাটি পড়লে এই তত্ত্বেরও একটা সংক্ষিপ্ত সমাধান পাবেন।

 

হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

 

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)

 

পরমব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমরা স্থূল দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে বিভক্ত করে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে এই তিনভাগে বিভক্ত করেছি এবং এই তিনটি সত্ত্বাকে আলাদা আলাদা তিনটি রূপ দান করেছি। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, এগুলো জাস্ট তিনটি নাম এবং এই তিনটি নাম পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের তিনটি কার্যকরী রূপের নাম মাত্র।

 

ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী। ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি যখন যে কাজ করেন, তখন সেই রূপের নামে কাজটি করেন, সেই তিনটি নামই হলো- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।

 

এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিষ্ণুর আংশিক অবতার রাম কি যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? কৃষ্ণ কি ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তারই নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তারই নাম বিষ্ণু এবং যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তারই নাম শিব বা মহেশ্বর; যে কথা একটু আগেই বলেছি এবং যে কথা বলা আছে গীতার এই শ্লোকে-

 

“অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্।

ভূতভর্তৃ চ তজজ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ।।”

 

অর্থ- পরমেশ্বরকে যদি যদিও সমস্ত ভূতে বিভক্তরূপে বোধ হয়, কিন্তু তিনি অবিভক্ত। যদিও তিনি সর্বভূতের পালক, তবু তাঁকে সংহার কর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলে জানবে।

 

এতক্ষণে পাঠক-পাঠিকাদেরকে নিশ্চয় এটা বোঝাতে পেরেছি যে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কেউ নয়, তারা একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ; এই ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করেন তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেহেতু যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, সেহেতু প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমন কি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই!!


 

 

আমরা সরস্বতী পূজার আগে কুল বা বরই খাই না কেন?

 

সরস্বতী দেবীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদরিকাশ্রমে তপস্য করেছিল তপস্যা শুরুর পূর্বে তার তপস্য স্থলের কাছে একটি কুল বা বরই বিচি/বীজ রেখে সর্ত দেয়া হলো, এই কুলবীজ অংকুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হবে যেদিন সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হবে, সেই দিন তার তপস্য পূর্ণ হবে বা সরস্বতী দেবীকে তুষ্ট হবে ব্যাসদেবও সেই সর্ত মেনে নিয়ে তপস্যা শুরু করলেন ধীরে ধীরে বেশ কয়েক বছর এই কুলবীজ অংকুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হয় এবং একদিন তা পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হয়, তখন ব্যাসদেব বুঝতে পারে যে, সরস্বতী দেবী তার প্রতি তুষ্ট হয়েছেন (কুল বা বরই এর আর এক নাম বদ্রী, তপস্যার সাথে বদ্রী এর সম্পর্ক থাকায় জায়গার নাম বদরিকাশ্রম নামে প্রচার হয়ে যায়) দিনটি ছিল শ্রীপঞ্চমীর দিন সেদিন বেদমাতা সরস্বতী কে বদ্রী/কুল ফল নিবেদন করে অর্চণা করে তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেন শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবী তুষ্ট হয়েছিলেন তাই সেই দিনের আগে আমরা কুল ভক্ষণ করি না শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবীকে কুল নিবেদন করার পরেই কুল ভক্ষণ করি স্খাস্থ্যগত কারণেও সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া ঠিক না কারণ মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগে কুল কাচা বা কশযুক্ত থাকে কাচা বা কশযুক্ত কুল থেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে হাজার হাজার বছর পূর্বে আমার ধর্ম যা বলে গেছে, আজ বিজ্ঞান গবেষনা করে তার সত্যতা পাচ্ছে

 

 

সরস্বতী দেবী সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

 

১। মা সরস্বতী গায়ত্রী রুপে বেদের মাতা।

২। ধ্যান অনুসারে তিনি কখনো চতুর্ভূজা আবারদ্বিভূজা।

৩। মা সরস্বতীর বাহন রাজহংস হলেও ধ্যাণের পার্থক্যে ময়ূর ও দেখা যায় ।

৪। সরস্বতী বৈদিক দেবী । বেদে সরস্বতীকে বিশেষস্থান দেওয়া হয়েছে ।

৫। তিনি তার হাতে বীণা পুস্তকএবং অক্ষমালা ধারণ করে আছেন ।

৬। তিনি সকল প্রকার বিদ্যারঅধিষ্ঠাত দেবী যেমন : শাস্ত্র,বিজ্ঞান,নৃত্য,গীত, অঙ্কন ইত্যাদি।

৭। মা সরস্বতীর গায়ের রং শুভ্র তূষারের মত।

৮। মা সরস্বতীর আসন শ্বেত পদ্ম।

৯। মা সরস্বতীর আদিরুপ হল মহাসরস্বতী যিনি সৃষ্টির আদিতেইসৃষ্টি হয়েছিলেন ।

 

প্রনাম_মন্ত্র

ঔঁ সরস্বতী নমঃ নিত্যং ভদ্রকাল্য নমঃ বেদ বেদান্ত বেদাঙ্গ বিদ্যাস্হাণেভ্য এবচ স্বাহাঃ

 

সরস্বতী_পূজা-

পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্র,প্রণাম মন্ত্র,স্তব ও প্রার্থনা মন্ত্র সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম প্রচলিত পূজা। সরস্বতী দেবীকে শিক্ষা, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী ওআশীর্বাদাত্রী মনে করা হয়। বাংলা মাঘ মাসের ৫মী তিথিতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা, সংগীত ও শিল্পকলায় সফলতার আশায় শিক্ষার্থীরা দেবীর পূজা করে থাকে। বাকদেবী, বিরাজ, সারদা, ব্রাহ্মী, শতরূপা, মহাশ্বেতা, পৃথুধর, বকেশ্বরী সহ আরো অনেক নামেই দেবী ভক্তের হৃদয়ে বিরাক করে। পুরাণ অনুযায়ী দেবী সরস্বতী ব্রহ্মের মুখ থেকে উথ্থান। দেবীর সকল সৌন্দর্য্য ও দীপ্তির উস মূলত ব্রহ্মা। পঞ্চমস্তকধারী দেবী ব্রহ্মা এক স্বকীয় নিদর্শন। পূজার জন্য দেবী সরস্বতীর মূর্তি শ্বেত বস্র পরিধান করে থাকে যা পবিত্রতার নিদর্শন। দেবীর আসন কে পুষ্পশোভা মন্ডিতকরে রাখা হয়। পরিবারের সকল সদস্য খুব ভোরে স্নান শেষে পরিস্কার বস্র পরিধান করে দেবীর সামনে অবস্থান করে থাকে। পুরোহিত পূজা শুরু করবার আগ পর্যন্ত দেবীর মুখ মন্ডল ঢাকা থাকে। পূজার অর্ঘ্যর পাশাপাশি দেবীর পূজার অারেকটি

 

প্রধান_অংশ

ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক। সরস্বতী পূজার একটি বিশেষ অর্য্য হল পলাশ ফুল। দেবীর অঞ্জলীর জন্য এটি একটি অত্যবশ্যকীয় উপাদান।

 

পুষ্পাঞ্জলী_মন্ত্রঃ(৩ বার পাঠসহ)

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।

বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,ভগবতী ভারতী দেবী

নমহস্তুতে।।

নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।

বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত- বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।

এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।

 

প্রনাম_মন্ত্রঃ

নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।

জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।

বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

 

সরস্বতীর_স্তবঃ

শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।

শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলে পনা।।

শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।

শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারবভূ ষিতা বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।

পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।।

স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রী সরস্বতীম্।

যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ংসর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তিতে।।

 

মাঘের পঞ্চমী তিথিতে শীত প্রভাতের শিশির মাখানো পলাশ ও গাঁদা ফুলের সমারোহ যেন প্রকৃতির নয়ন জুরানো নৈসর্গিক দৃশ্য। চিরাচরিত নিয়মে, মা মমতাময়ী বিদ্যার দেবী নেমে আসছেন এই ধরাতে। তাইতো আমরা মায়ের করুণায় বিদ্যা অর্জন করছি, তাইতো আমরা মেতে উঠি পূজা উসবে।

 

 

 

ব্রহ্মা ও সরস্বতীদেবীকে নিয়ে মুসলিমদের অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব!

বর্তমানে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরীদের দারুন আগ্রহের বিষয় হলো হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর ভূমিকা।

এদের কারো কারো কাছে সরস্বতী- ব্রহ্মার কন্যা; কারো কাছে আবার সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনী। আগে তো ঠিক কর সরস্বতী- ব্রহ্মার কে, তারপর তাদের সম্পর্কে কাহিনী বানা। কেউ কেউ আবার বলে, স্বর্গের নর্তকী উর্বশীকে দেখে ব্রহ্মা নাকি এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়তো যে, সে হস্তমৈথুন করতো এবং সেই হস্তমৈথুন জাত বীর্য নাকি সে আবার একটা পাত্রে সংরক্ষণ করতো, সেই পাত্র থেকেই নাকি জন্ম ঋষি অগস্ত্যর । এরা কখনো ব্রহ্মাকে মানুষ বানাচ্ছে, যে মানুষ সুন্দরী নারীকে দেখে উত্তেজিত হয়, কাম সামলাতে না পেরে হস্তমৈথুন করে; আবার এরাই ব্রহ্মাকে মহাশক্তিশালী দেবতা বানাচ্ছে, যে দেবতা পাত্রে জড়ো করে রাখা বীর্য থেকে কারো জন্ম দিতে পারে। আগে তো ঠিক কর ব্রহ্মা- মানুষ না দেবতা, তারপর তার সম্পর্কে গল্প বানা।

মুসলিমদের অপপ্রচারের নমুনা:

বেদ পুরানে যা ই থাক, হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বকে উপলব্ধি করার বা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তাদের থাক বা না থাক মুসলমানরা বিশ্বাস করে সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা এবং এই ব্রহ্মা ও সরস্বতীর যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। গল্পটা বেশ রসালো আর আকর্ষণীয়ও, তাই বোধহয় এটা নিয়ে এত চর্চা।

মানুষ দুটো কারণে কোনো কিছুর চর্চা করে;

প্রথম হলো বিষয়টা তার কাছে খুব ভালো লেগেছে, তাই সে সেটা নিয়ে আলোচনা করে অন্যের সাথে তার সেই আনন্দকে ভাগ করতে চায়; আর
দ্বিতীয় কারণ হলো ঈর্ষা, ওর আছে ও পাচ্ছে; আমার নেই, আমি পাচ্ছি না কেনো- এই ঈর্ষা।
বেদ এর ভুল ব্যাখ্যায় পুরানের এই বিকৃত গল্প নিয়ে হিন্দুদের কোনো মাথা ব্যাথা বা আগ্রহ না থাকলেও এর প্রতি মুসলমানদের এই প্রবল আগ্রহের কারণ হলো এই ঈর্ষা। তাদের মতে, ব্রহ্মা তার কন্যা সরস্বতীর সাথে সেক্স করতে পেরেছে, তাহলে আমরা পারছি না কেনো ? ঈর্ষার কারণ মূলত এটাই।

কিন্তু এটা নিয়ে এত হতাশায় ভোগার কী আছে ? ইসলামে তো দত্তক নেওয়া কন্যাকে বিয়ে করার পারমিশন আছে, কন্যাসমরা তো কন্যাই, সেটা দত্তক হোক আর নিজের হোক। তো সেই দত্তক নেওয়া কন্যাকে বিয়ে করতে পারলে নিজের কন্যাকে বিয়ে করতে দোষ কোথায় ? ইসলামের স্বীকৃত নবী হযরত লুত এর উদাহরণ তো আছেই; কারণ বাইবেলের অংশ জেনেসিস এর ১৯/৩৩-৩৬ তে বলা আছে, “স্ত্রী মারা গেলে হযরত লুত তার বয়স্ক দুই কন্যার গর্ভে পুত্র উপাদন করেছিলো”- তাই, এত হায় হুতাশ না করে হযরত লুত এর উদাহরণটা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ কর না ?

বেদ এর সূত্রকে অবলম্বন করে পুরানের গল্পগুলো রচিত। কিন্তু যারা পুরানের গল্পগুলো লিখেছিলো, তারা যে বেদ এর ভাষ্যকে ঠিক মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিলো, এই বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আবার এটাও হতে পারে দীর্ঘদিন মুসলিম দুঃশাসনের অধীনে থাকার কারণে পুরানের গল্পগুলো বিকৃত হয়েছে; কারণ, মুসলমান শাসকদের লক্ষ্যই ছিলো হিন্দুধর্ম ও জাতিকে ধ্বংস করা, এজন্য তারা শুধু হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলোকে বিকৃতই করে নি, নতুন নতুন পুরান নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করিয়ে হিন্দুধর্মের গ্রন্থ বলে চালিয়ে দিয়েছে। এরকম কয়েকটি গ্রন্থহলো- ভবিষ্যপুরান, আল্যাউপনিষদ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান এবং এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে মুসলমান শাসকদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয় জয়দেব এর গীত গোবিন্দ, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং বৈষ্ণব পদাবলী

ভারতে ছাপাখানা আসার আগে প্রয়োজনীয় সমস্ত গ্রন্থ হাতে লিখে নতুন কপি বানানো হতো। যাদের হাতের লেখা ভালো ছিলো তারা এই কাজটা করতো, অনেকের এটা পেশাও ছিলো। এরা কখনো কখনো মূল বই লিখতে লিখতে তাতে নিজের কথা ঢুকিয়ে দিতো, এভাবেও হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলো বিকৃত হয়েছে। কিন্তু এই লিপিকারদের হাতে বেদ এর বিকৃতি তেমন হয় নি, কোলকাতার ব্রাহ্ম সমাজ এর বুদ্ধি ও সহযোগিতায়

বেদ এর বিকৃতি ঘটিয়ে প্রিন্ট করে ইংরেজরা। কিন্তু লিপিকারদরে হাতে ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে পুরানের গল্পগুলির, শুধু তাই নয়, তাতে যোগ হয়েছে নতুন গল্প এবং গল্পের শাখা প্রশাখা। আজকের প্রসঙ্গ যেহেতু ব্রহ্মা ও সরস্বতী, সেহেতু এই প্রসঙ্গেই পুরানের গল্পগুলির যে কী হাল, তার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি-

পুরাণের একটি কাহিনী অনুযায়ী, স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশীকে দেখে স্বমেহন মানে হস্তমৈথুন করতেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার শুক্রাণু জমা হতো একটি পাত্রে। সেই পাত্রেই জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্যর এবং পরবর্তীতে অগস্ত্য জন্ম দেন সরস্বতীর। এই সূত্র অনুযায়ী - সরস্বতী ব্রহ্মার নাতনী।

এখন আপনি ই বলুন, ব্রহ্মা কি মানুষ, যে সুন্দরী কোনো নারীকে দেখে তার কাম জাগ্রত হবে আর সেই কামকে প্রশমিত করার জন্য সে স্বমেহন করবে ? এরপর বলা হচ্ছে ব্রহ্মার শুক্রানু জমা হতো একটি পাত্রে, সেই পাত্র থেকে জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্যের। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র মতে মূল তত্ত্ব হচ্ছে, ব্রহ্মা তার মনের শক্তি দ্বারাই তার পুত্রদের সৃষ্টি করতে পারতেন, এজন্যই তাদেরকে বলা হয় ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মার চরিত্রে আরোপিত এই যে বিপরীত ধর্মী ঘটনা, এটা কিভাবে সম্ভব ? কারো মধ্যে যদি এই ক্ষমতা থাকে যে, সে তার চিন্তা শক্তির দ্বারাই কাউকে হত্যা করতে পারে, তাহলে সে ম্যানুয়ালি চাপাতি নিয়ে কাউকে হত্যা করতে যাবে কেনো ?

এই কাহিনী অনুযায়ী পাত্র থেকে উদ্ভূত ঋষি অগস্ত্য জন্ম দেয় সরস্বতীর। তাহলে নিশ্চয় সরস্বতীর একজন মা থাকা চাই, কিন্তু সরস্বতীর মায়ের খবর কেউ কি জানেন ? কিন্তু ঋষি অগস্ত্যের একজন স্ত্রী ছিলো, নাম লোপামুদ্রা। সেই হিসেবে লোপামুদ্রা সরস্বতীর মা হওয়ার কথা। কিন্তু এমন কথা কেউ কখনো কি শুনেছেন ? আরেকটি কাহিনী অনুযায়ী অপ্সরা উর্বশীকে দেখে কোনো এক যজ্ঞকুম্ভে বীর্যপাত হয় আদিত্য ও বরুনের। সেই যজ্ঞকুম্ভ থেকে অগস্ত্য ও বশিষ্ঠের জন্ম হয়। মূল কাহিনী অনুযায়ী এই বশিষ্ঠ কিন্তু আবার ব্রহ্মার মানসপুত্রদের একজন। চিন্তা করুন অবস্থা!

এইভাবে পুরানের গল্পগুলোর গরু শুধু গাছেই নয়, আকাশেও চড়ে বেরিয়েছে। এজন্যই পুরানের গল্পগুলো শুধুই গল্প, এগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এবং এই গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তেও আসা যায় না। কিন্তু এই পুরানগুলো আবার মহর্ষি বেদব্যাসের নামেই বাজারে প্রচলিত, এখন আপনিই চিন্তা করুন, যে বেদব্যাস মহাভারতের মতো একটি বিশুদ্ধ মহাকাব্যের রচয়িতা, যে মহাকাব্যে একটিও ভুল না থাকার কারণে ছোটখাটো কোনো ত্রুটি বিচ্যুতিতে- “মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে” ব’লে প্রবাদ বাক্যের উপত্তি, সেই মহাভারত রচয়িতা কি এমন সব গাঁজাখোরি পুরানের গল্প লিখতে পারে ? এসব বিচারে স্পষ্ট যে, বর্তমানে বাজারে প্রচলিত সব পুরাণ হিন্দুধর্মের প্রামান্য গ্রন্থ নয়

আবার অন্য একটি কাহিনী মতে, ব্রহ্মার শুক্রাণু থেকে সরাসরি জন্ম হয় সরস্বতীর। কিন্তু নিজের মেয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হন পিতা প্রজাপতি ব্রহ্মা। সরস্বতী বড় হলে তাঁর সঙ্গে সে যৌনসঙ্গম করতে চায়। জন্মদাতার কামনা থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে সরস্বতী। সরস্বতী ব্রহ্মার চোখের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তার উপর নজর রাখতে নিজের ঘাড়ের উপর পাঁচদিকে পাঁচটি মাথা তৈরি হয়ে যায় ব্রহ্মার। সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নানা পশুর ছদ্মবেশ ধরে পালাতে থাকে। ব্রহ্মাও একে একে সেইসব পশুর পুরুষ রূপ ধারণ করে সরস্বতীর পিছু নেয়। বলা হয়, এইভাবেই তৈরি হয় জীবকূল। সরস্বতী বাঁচতে একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেয়। ব্রহ্মা সেই গুহাতেই মিলিত হন সরস্বতীর সঙ্গে। সরস্বতী ছিলো ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু তার সঙ্গেই মিলিত হন ব্রহ্মা। এই অবৈধ যৌনাচারের অপরাধে শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মাথাটি কেটে দেন এবং অভিশাপ দেন যে, ধরাধামে কেউ ব্রহ্মার পূজা করবে না।

এই জন্যই নাকি পৃথিবীতে শিব ও বিষ্ণুর পূজার প্রচলন থাকলেও ব্রহ্মার পূজার প্রচলন নেই। যেমন ঘটনা, তেমনি সেই ঘটনার পেছনের কাহিনীর ব্যাখ্যা!

এই কাহিনীতে বলা হচ্ছে, ব্রহ্মার শুক্রানু থেকে জন্ম হয় সরস্বতীর। তাহলে শুক্রানুর সাথে তো ডিম্বানুরও প্রয়োজন হবে, তাহলে সেই ডিম্বানুটা কার ? পরে বলা হলো, সরস্বতী বড় হলে তার রূপ মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মা তার সাথে সেক্স করতে চায়। এখানে বোঝা যাচ্ছে, মানব সন্তানের মতো শিশু রূপেই সরস্বতীর জন্ম হয়েছে, তাহলে তার মা কে ? সরস্বতী শিশু ছিলো, বড় হলে তার প্রতি তার পিতা ব্রহ্মা আকৃষ্ট হয়, তার মানে সরস্বতী এক পর্যায়ে বৃদ্ধা হয় এবং মারাও যায়, তাহলে তার মৃত্যুর ইতিহাসটা কোথায় ?

আরো বলা হচ্ছে, ব্রহ্মার চোখের আড়াল হওয়ার জন্য সরস্বতী লুকানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু তার উপর নজর রাখার জন্য ব্রহ্মার পাঁচদিকে পাঁচটি মাথা তৈরি হয়। যে ব্রহ্মা মন থেকেই সব সৃষ্টি করতে পারে, যার মনের এত ক্ষমতা, তার চোখের আড়াল হওয়া কি সম্ভব ? সরস্বতী যাতে চোখের আড়াল না হতে পারে, সেজন্যই নাকি ব্রহ্মার ঘাড়ের উপর পাঁচটি মাথা তৈরি হয়, কিন্তু দিক তো চারটি, তাহলে পাঁচটি মাথার প্রয়োজন হলো কেনো ? নাকি পৃথিবীতে ব্রহ্মার পূজার প্রচলন কেনো নেই, সেই ব্যাখ্যা দেবার জন্য ব্রহ্মার উপর একটি অভিশাপের গল্পের প্রয়োজন ছিলো, সেজন্য ব্রহ্মার পাঁচটি মাথার গল্প বানিয়ে তা থেকে শিবের মাধ্যমে একটি মাথা কেটে ফেলা হয়েছে এবং ব্রহ্মার উপর শিবের অভিশাপকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আষাঢ়ে গল্পকাররা বোধহয় জানতো না যে, উপত্তির দিক থেকে শিবের চেয়ে সিনিয়র হলো ব্রহ্মা। যদিও শিব এবং ব্রহ্মা একই লেভেলের দেবতা, কিন্তু মন্ত্রীসভার- বয়সে জুনিয়র কোনো পূর্ণমন্ত্রী কি, তার চেয়ে সিনিয়র কোনো পূর্ণমন্ত্রীর উপর ক্ষমতা খাটাতে পারে ? দুজনই তো পূর্ণমন্ত্রী, তাদের ক্ষমতাও এক ?

এরপর বলা হচ্ছে, সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নানা পশুর ছদ্মবেশ ধরে পালাতে থাকে, ব্রহ্মাও একে একে সেইসব পশুর পুরুষ রূপ ধারণ করে সরস্বতীর পিছু নেয় এবং এইভাবেই তৈরি হয় জীবকূল বা প্রাণীজগ

পুরান রচয়িতারা যেহেতু আগেই বলে দিয়েছে যে, ব্রহ্মার কামাবেগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলো সরস্বতী, তাই তাদেরকে সরস্বতীর এই নানা ছদ্মবেশ ধারণের সাথে সাথে তাকে পালানোর ভূমিকায় দেখাতে হয়েছে। কিন্তু আমি যখন এর মূলকাহিনী এই পোস্টের শেষের দিকে বর্ণনা করবো, তখন বুঝতে পারবেন আসলে প্রকৃত ঘটনাটা কী ?

এরপর বলা হচ্ছে, সরস্বতী বাঁচতে একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেয়। ব্রহ্মা সেই গুহাতেই মিলিত হন সরস্বতীর সঙ্গে। যে মন থেকেই সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে, যে চাওয়া মাত্রই তার মাথার পাশে আরও চার/পাঁচটি মাথার গজিয়ে যায়, তার হাত থেকে পালিয়ে গুহার ভেতর আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা কি বৃথা নয় ?

এরপর একটি পদ্মফুল সরস্বতীর সাথে নাকি ব্রহ্মা ১০০ বছর ধরে মিলিত হয় এবং তাদের কয়েকটি ছেলে মেয়েও হয় এবং এখানে মুসলমানদের অভিযোগ হচ্ছে, তাদের ভাষায় পিতা ব্রহ্মার সাথে সরস্বতী এই যৌনক্রিয়া কখনোই করতে চায় নি, তাই এটা এক প্রকারের ধর্ষণ। যদিও এটা কাহিনীর স্বীকৃতি নয়, তবুও শুধু তর্কের খাতিরে বলছি, সরস্বতীর যদি ইচ্ছাই না থাকতো তাহলে সে ঐ গুহা থেকে বের হয়ে পদ্মফুলে হানিমুন করতে এলো কেনো ? আর এই পদ্মফুলটা কত বড় ছিলো আর কোনো সরোবরে ছিলো, যে তা ১০০ বছর ধরে জীবিত ছিলো আর কয়েকজন মানুষের সংসারকে ধারণ করে রাখতে পারলো ? নব্য হিন্দু ধর্মজ্ঞানীদেরকে বলছি, এই পোস্টে উল্লেখ করা আমার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর মরদ হলে দিয়ে যাবেন, আর দিতে না পারলে বুঝবো, যারা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সব কিছু না জেনে পুরানের কিছু বিকৃত ও অতিরঞ্জিত কাহিনী নিয়ে হিন্দু ধর্মকে দোষারোপ করে তারা…………।

এক একজন দেব-দেবীকে নিয়ে যত পুরান লিখা হয়েছে তার প্রত্যেকেটিতে তাদেরকে আলাদা আলাদা ঘটনায় উপস্থাপিত করা হয়েছে। তাই কোনো পুরানের সাথে কোনো পুরানের গল্পের হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিল নেই, যদিও দেব-দেবী সব এক, এটা কিভাবে সম্ভব ? সম্ভব এ্ই ভাবেই যে, হয়- পুরান রচয়িতারা বেদকে ঠিক ভাবে বুঝতে পারেনি, না হয় পরবর্তীতে লিপিকারদের হাতে পুরানগুলো বিকৃত হয়ে কাহিনীর নানা রূপ লাভ করেছে।

এবার অপপ্রচারের জবাব দেয়া যাক

এখন হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব মতে, ব্রহ্মা ও সরস্বতীর আসল স্টোরিটা কী, দেখুন :

হিন্দুশাস্ত্র মতে, সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হলো পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ব্রহ্মও বলা হয়। পরমাত্মারূপে এই ব্রহ্ম সবকিছুর মধ্যে বিরাজিত, এই জন্যই হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”

এর অর্থ হলো- সকলের মধ্যে ব্রহ্ম বিদ্যমান। - (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩/১৪/১, বেদান্ত দর্শন)

এই ব্রহ্ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রহ্ম, যখন সৃষ্টি করেন, তখন তার নাম ব্রহ্মা; যখন তিনি পালন করেন, তখন তার নাম বিষ্ণু; যখন তিনি বিনাশ করেন, তখন তার নাম শিব বা মহেশ্বর। কিন্তু আমাদের পুরান রচয়িতারা বেদ এর সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে বুঝতে না পেরে, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে তিনটি আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করে নিয়ে তাদেরকে আলাদা আলাদা রূপ দিয়ে দিয়েছে, শুধু তাই নয় তাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদও লাগিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে মানুষ রূপে কল্পনা করে তাদের দিয়ে আরো যা করিয়েছে তা তো উপরে করা বর্ণনায় কিছুটা বুঝতেই পারলেন।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে; তো যখন প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করেন বা ফাইলে সই করেন, তখন তিনি কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী; ব্রহ্মও ঠিক সেরূপ, তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী, কিন্তু তিনি কাজ করেন সাধারণ মন্ত্রী হয়ে, সাধারণ মন্ত্রীর নামে।

এই ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, অনেকে বা সকলেই জানেন, বিষ্ণু পালন কর্তা। তাহলে বিষ্ণুর অবতারদের তো যুদ্ধ, ধ্বংস, বিনাশ এই সব করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাম কী যুদ্ধ করে রাবনের বংশকে বিনাশ করে নি ? শ্রীকৃষ্ণ কি নিজে কংস, শিশুপাল, নরকাসুরকে হত্যা করে নি ? ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ, দুর্যোধনকে হত্যা করায় নি ? পাণ্ডবদের মাধ্যমে কুরুবংশকে ধ্বংস করে নি ? বিষ্ণু যদি কোনো আলাদা সত্ত্বা হতো আর তার কাজ শুধু যদি পালন করা হতো, তাহলে কি সে এই যুদ্ধ, বিনাশগুলো করতো ? আসলে এগুলো করিয়েছেন ব্রহ্ম, আমাদের শাস্ত্রকারা তাদেরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কল্পনা করে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। না হলে পৃথিবীতে এত বিষ্ণুর অবতার, সেই তুলনায় ব্রহ্মা ও শিবের কোনো অবতার নেই কেনো ? আসলে- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তো আলাদা কেউ নয়।

যা হোক, ব্রহ্মের ব্রহ্মা রূপের কাজ হলো সৃষ্টি করা। তো সৃষ্টি করতে লাগে নারী ও পুরুষ সত্ত্বা। সরস্বতী হলো পুরুষরূপী ব্রহ্মার নারী শক্তি। যে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে লাগে জ্ঞান, এজন্য সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে। কোনো কিছু সৃষ্টি করার সময় সবদিকে নজর রাখতে হয়, এই সবদিকে নজর রাখার প্রতীক হিসেবে ব্রহ্মার চারমাথা। উপরেই পড়েছেন, ব্রহ্মার কাছ থেকে বাঁচার জন্য সরস্বতী বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধরে পালাতে থাকে আর তার পিছু পিছু ঐ প্রাণীর পুরুষ রূপ ধরে ব্রহ্মা তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে, এভাবেই সৃ্ষ্টি হয় জীবকূল; এটা আসলে বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। দৌড়াতে দৌড়াতে সরস্বতী গিয়ে আশ্রয় নেয় গুহার মধ্যে; এটা হলো, বিবর্তনের শেষ ধাপ মোটামুটি আধুনিক মানুষের গুহার জীবন এবং তারপর পদ্মফুলে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর বাস এবং তাদের ছেলে মেয়ের জন্ম আসলে আধুনিক সভ্য মানুষের জীবন যাপনের প্রতীক।

এইভাবে হিন্দু শাস্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদ খুবই প্রতীকী রূপে ও সংক্ষিপ্তভাবে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে না বুঝে আমাদের পুরাণ রচয়িতারা যেন-তেন ভাবে সেগুলোকে ব্যাখা করতে গিয়ে যা-তা কাহিনী বানিয়ে ফেলেছে, আর পরবর্তী লিপিকারদের হাতে সেগুলো শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে নানা ভাবে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। আর এই সব বিকৃত পুরানের বিকৃত গল্পগুলোর উপর ভিত্তি করে বর্তমানের যৌন উন্মাদ মুসলমান পুরাণ রচয়িতারা এর সাথে যুক্ত করেছে যৌনতার নানা গল্প।

যৌনতায় মুসলমানদের যেমন কোনো নীতি নৈতিকতা নেই, তেমনি তাদের চিন্তারও ও কোনো নীতি নৈতিকতা নেই, তাই তারা সরস্বতীকে কখনো বানায় ব্রহ্মার মেয়ে, কখনো নাতনী, এই মেয়ের বা নাতনীর উপর কামলালসা চরিতার্থতা করার জন্য ব্রহ্মাকে নিজেদের মতো করে বানায় লম্পট, চরিত্রহীন, যে সুন্দরী নারী দেখে হস্তমৈথুন করে, কন্যার সাথে সেক্স করার জন্য তার পিছু দৌড়ায়, আরও কত কী ? আসলে যার যে রকম মন, সে বা তারা তো সেরকমই চিন্তা করবে, মুসলমানরা করেছে ঠিক তাই। তাই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মের ব্রহ্মারূপকে তারা বানিয়েছে নীচু শ্রেণীর মানুষ, আর তার নারীশক্তি সরস্বতী, তাদের কাছে ব্রহ্মার স্ত্রীও নয়, কন্যা-নাতনী! যেন গল্পটা আরো ভালো জমে আর তা দিয়ে প্রমান করা যায় যে হিন্দুধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব কত নোংরা, জঘন্য; কিন্তু এসব করতে গিয়ে তাদের নিজেদের পাছার কাপড় যে খুলে যাচ্ছে, যাবে, সেটা তারা বোধহয় কখনোই ভাবে নি। কারণ,

ইসলামকে বড় করে তোলার জন্য জাকির নায়েক মার্কা মুসলমানদের এই যে বাড়াবাড়ি, সেই বাড়াবাড়ির জবাব দিতে গিয়েই নতুনভাবে জন্ম হয়েছে, আমার এবং আমার মতো আরো অনেকের, এজন্য হিন্দু ধর্মের প্রকৃত সত্য যে শুধু বের ই হয়ে আসছে, তাই নয়, উন্মোচন হচ্ছে ইসলামেরও অন্ধকার দিকগুলো এবং আরো হবে, 


 


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ